দুঃখের ঈদ সুখের ঈদ

দুঃখের ঈদ সুখের ঈদ

জসিম মল্লিক

এবারের ঈদ হবে একেবারে অন্যরকম। এবারের ঈদ হবে কষ্টের, এবারের ঈদ হবে বেদনার। এবারের ঈদ স্বজন হারানোর এবং বন্দী দশার মধ্যে ঈদ হবে। করোনা দিনের ব্যাতিক্রমী এক ঈদ হতে যাচ্ছে আমাদের কানাডায়।

কারন কানাডায় লকডাউন ২ জুন পর্যন্ত চলবে। সুতরাং সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মেনে চলতে হবে সবাইকে। কোথাও ঈদের জামাত হবে না। ঘরে বসেই ঈদের নামাজ পড়তে হবে।
পাঁচজনের বেশি একত্রিত হতে পারবে না। দুই মিটার দূরত্ব মেনে চলতে হবে।

ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে নতুন পোশাক। ঈদ মানে মায়ের কাছে যাওয়া। ঈদ মানে স্বজন আর বন্ধুদের মিলনমেলা, হৈ-হুল্লোড়, ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু এবার সেই অনাবিল আনন্দের আবহ নেই। খুশির জোয়ারও নেই। সবকিছু থমকে গেছে। দেশে বিদেশে অনেকে মারা গেছেন। অনেকেই হাসপাতালে রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্বজন হারানোর বেদনা সর্বত্র্য। কিন্তু তবুও ঈদ আসে।

১.
এবার একটু ঈদের স্মৃতিচারন করা যাক...
ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। তখন ঈদের একটা অলাদা আমেজ ছিল। রোজার মাসে সাধারণতঃ শীত থাকত। শীতের রাতে জবু থবু হয়ে সেহ্রি খেতে উঠতে হতো। লেপের নিচ থেকে উঠতে ইচ্ছে করতো না। মা আগেই উঠে খাবার সব গরম করে রাখতেন। সারাদিন উপোস থাকতে কী কষ্টটাই না হতো! মনে আছে ছোটো বেলায় পানিতে ডুব দিয়ে একটু পানি খেয়ে নিতাম। ভাবতাম আল্লাহতো আর দেখতে পাবে না! ইফতারির আগে সময় যেনো ফুরোতেই চাইতো না। রাতে চলে যেতাম তারাবির নামাজ পরতে মসজিদে। মাসব্যাপী রোজা শেষে যেদিন চাঁদ দেখার কথা সেদিন কী উত্তেজনাই না বিরাজ করত ছোটদের মধ্যে। চাঁদ দেখার জন্য খোলা মাঠে ছুটে যাওয়া বা উঁচু কোন জায়গায় উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। চাঁদ দেখা গেলে কী আনন্দ। কাল ঈদ! রেডিও টেলিভিশনে বেজে উঠে ..’রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ..’ সারারাত আনন্দে ঘুমই হয় না। রাতে তারাবাতি জ্বালানো হতো।

রোজার মাস জুড়ে আছে নতুন কাপড় কেনা কাটার ধুম। বাবার হাত ধরে গ্রামের হাটে চলে যাওয়া ঈদের শার্ট কিনতে। প্রত্যেক বাবা মাই চায় তার সন্তানের জন্য নতুন কাপড় কিনে দিতে। কিনে দিতে না পারলে যেমন দরিদ্র পিতার মন খারাপ হয় তেমনি সন্তানেরও আনন্দটা নষ্ট হয়। ঈদে তার সন্তান নতুন কাপড় পড়বে না তা কি হয়! ছোটরা নতুন কাপড় কিনে কেউ কাউকে দেখাত না। ঈদের আগেই দেখে ফেললে মজাটা নষ্ট হয়ে যায় না! তাই লুকিয়ে রাখে। এই নিয়ে ছোটদের মধ্যে মন কষাকষিও হয়। আর যারা নেহায়েৎই নতুন কাপড় কিনতে পারে না তারা পুরনো কাপড়টাকেই ভালমতো ধুয়ে ঈদের রাতে ইস্তিরি করে নেয়। ধোপাবাড়িতেও যেনো উৎসব লেগে যায়।

২.
রোজার পুরো মাস মসজিদে মসজিদে তারাবির নামাজ আর ইফতারির ধুম।
শবে কদরে সারারাত ছেলেদের ঘুরে ঘুরে মসজিদে নামাজ পড়া আর রুটি হালুয়া খাওয়া। যার যে রকম সাধ্য আছে সে সেই রকমভাবে ঈদ করে। আজকাল কত বদলে গেছে সব কিছু। কেউ হয়ত কোন রকম ইফতারিটা সেড়ে ফেলে আর কেউ কেউ শেরাটন সোনারগাঁয়ে তিন চার হাজার টাকা দিয়ে ইফ্তার করে। ঢাকা শহরে ইফতারির বাজার বসে যায় সর্বত্র্য। ইফতার কালচার বলে একটা কথা চালু হয়ে গেছে দেশে। রাজনৈতিক ইফতার বেশ জমজমাট। জাকাতের কাপড় বিলি করতে গিয়ে কত লোক মারা যায় দেশে। ঈদের সময় দুর দুরান্ত থেকে ভিক্ষুকরা এসে ভীড় করে ঢাকায় দুটো পয়সার জন্য।

ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ঘরে ঘরে গিয়ে সেমাই ফিরনি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। তারপর গোসল টোসল সেড়ে কড়কড়া ভাজভাঙ্গা জামাকাপড় পড়ে মা বাবাকে সালাম করে ঈদগাহ মাঠে যাওয়া হয় দল বেঁধে। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করা। ছোট ভাই বোনের জন্য খুরমা, বেলুন, বাঁশি কিনে আনা। নামাজ পড়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে মায়ের পোলাউ মাংস রান্না শেষ। তারপর খাওয়া দাওয়ার ধুম। বিকেল হলে সেজে গুজে আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া। সত্যি আমাদের দেশের ঈদ উৎসবের কোন তুলনা হয় না। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে যায়। আজকের দিনে হয়ত আর সেই পুরনো আমেজটা নেই কিন্তু তারপরও দেশের ঈদ বলে কথা!

৩.
কিন্তু আমরা যারা দূর প্রবাসে থাকি তাদের ঈদ কেমন?।
এখানেও রোজা আসে, তারাবি হয়, ইফতার পার্টি হয়। সবকিছুই হয়। কিন্তু কোনভাবেই তা দেশের মতো না। দেশে যেমন রোজা শুরু হলেই একটা উৎসবের আমেজ তেরী হয়। কেনা কাটা, ঈদের বোনাস, লাইটিং, ঈদ ফ্যাশন, ঈদ সংখ্যা পত্রিকা, টিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান, ঈদ পুনর্মিলনী, সিনেমা হলে নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়া কত কি। প্রবাসে এসব কিছুই নেই। প্রবাসে ঈদের দিনটা উইকএন্ডে হবে কিনা এই নিয়ে চলে গবেষনা। কারন উইকডেজে হলে ঈদের দিন কাজে যেতে হবে। বাচ্চাদের যেতে হবে স্কুলে। যদিও এদেশে ঈদের দিন মুসলিম ছাত্ররা ছুটি ভোগ করতে পারে। দেশে যখন সবাই ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে তখন প্রবাসে আমাদের থাকতে হয় কাজের যায়গায়। কখন ঈদের দিনটা চলে যায় টেরও পাওয়া যায় না। বাসে সাবওয়েতে বসে বা গাড়ির ড্রাইভিং সীটে হাত রেখে আর চোখের জলে বাবা মা ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে যায়। যারা বাবা-মা কে হারিয়েছেন বা হারিয়েছেন কোন আপনজনকে তাদের কথা বেশি বেশি মনে পড়ে এই দিনে। প্রবাসে অনেক সন্তান হারা মা লুকিয়ে কাঁদেন। তার যাদু আর ফিরবে না এই আনন্দের দিনে।

যে যুবকটি তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে এসেছে, তার কি খুব কষ্ট হবে না! যাদের বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই-বোন রয়েছে দেশে, কোন এক নির্জন মুহূর্তে সে-কি চোখের পানি ফেলবে না! বিশেষ করে প্রবাসী মেয়েরা ভীষণভাবে মিস করবে তার আত্মীয়-পরিজন কে। কেউ কেউ ঈদের দিন কাজের মধ্যেই আনমনা হয়ে পড়বে। বাসে, সাবওয়েতে চলার সময় খুব গোপনে একটু কেঁদে নেবে। অনেকেই ঈদের দিন আপনজনদের ফোন করবে। সার্কিটগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যে মায়ের একমাত্র মেয়ে বা একমাত্র ছেলে বিদেশ থেকে ফোন করবে সেই মার কণ্ঠ জড়িয়ে আসবে আবেগরুদ্ধ কান্নায়। যে ব্যক্তি অনেকদিন তার স্ত্রী-সস্তানকে রেখে এসেছেন তার বুকটা কি ভেঙে যাবে না!

আনন্দ বেদনার ঈদের নাম হচ্ছে প্রবাস ঈদ। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে নেয় প্রবাসীরা। তারাও ঈদের নামাজ পড়ে, কোলাকুলি করে, বেড়াতে যায় বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু তারা প্রিয়জন থেকে অনেক অনেক দুরে। তাদের শূন্যতা কিছু দিয়ে পূরন হবার নয়।

৪.
আমরা ঈদ নিয়ে ছোটবেলায় যতখানি আবগেপ্রবন ছিলাম আজকের দিনে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেই আবেগটা আর নেই। কি দেশে কি বিদেশে। তারা এটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না। অথচ আমাদের সময় রোজার শুরু থেকেই একটা উত্তেজনা ছিল। তখন স্কুল কলেজ থাকত বন্ধ। আজকের দিনে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে না।

প্রবাসের নতুন প্রজন্ম দেশের আত্মীয় পরিজন নিয়েও মাথা ঘামায় না। দাদা-দাদী বা নানা-নানী যে একটা বিশাল বড় ব্যাপার সেটাই তারা বোঝে না। এমনকি মা বাবাকে যে সালাম করার যে একটা রেওয়াজ ছিল সেটাও তারা জানে না। এখনকার বাবা মায়েরাও আর এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়। সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পুরনো মূল্যবোধকে। আগের দিনের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে ততটা মূল্যবান নয়। আমরা যেমন মাঠে ঘাটে দৌড়া দৌড়ি করতাম, ঘুরি উড়াতাম, মার্বেল খেলতাম, গাছে চরতাম, এখন সেসব নেই। এখন নতুন প্রজন্ম এসএমএস করা, এক্সবক্স খেলা, কম্পিউটারে চ্যাট করা না হয় কানে আইপড লাগিয়ে নিজের মতো ব্যস্ত থাকে। এটাই হয়ত সময়ের দাবি!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল 

এই রকম আরও টপিক