‘করোনা রোগীরা যেন চিকিৎসাবঞ্চিত না হয় তা মনিটর দরকার’

‘করোনা রোগীরা যেন চিকিৎসাবঞ্চিত না হয় তা মনিটর দরকার’

ফরিদ কবির

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী

এ দেশের মঙ্গলের জন্য আপনার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই, এটা সম্ভবত আপনার শত্রুরাও স্বীকার করবেন। করোনাকালে আপনার সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু অনেক পদক্ষেপ কার্যকর হলেও কিছু বিষয় নজর এড়িয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়।

এ লেখাটা সে কারণে কিছুটা সমালোচনাধর্মী হলেও আমি মনে করি, এই সমালোচনা উদারচিত্তে গ্রহণ করার এবং সে অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার মানসিকতা আপনার আছে।

এদেশে করোনা ভাইরাস ঢোকার পর থেকে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। কোনো রোগীই, তিনি করোনা আক্রান্ত হন বা না হন কেউই আসলে সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না! বিশেষ করে, কোভিড সাসপেক্টেড বা করোনার লক্ষণ থাকলে সেসব রোগীকে কোনো হাসপাতালেই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, করোনা ভাইরাসের টেস্ট থেকে শুরু করে করোনা চিকিৎসাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতেই চেয়েছেন। ফলে, করোনা টেস্ট থেকে শুরু করে করোনা রোগীদের চিকিৎসা একটা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।

আর, এর ফলে, করোনা ভাইরাস টেস্টের সুবিধা পেতে এখনো লোকজনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সত্যি বলতে সাধারণ মানুষ এই টেস্টের সুবিধা বলতে গেলে পাচ্ছেই না! কেন করোনা টেস্টের সঙ্গে ও করোনার চিকিৎসাসেবায় বেসরকারি বা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে যুক্ত করা হলো না, এ প্রশ্নের জবাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই দেওয়া উচিত। যারা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মারা গেলেন তাদের দায় তারা কীভাবে এড়াবেন?

এবার আসি আমাদের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রসঙ্গে। হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা কি মানুষ পাচ্ছে?

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নির্দেশ দিয়েছেন একজন মানুষও যেন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে করোনা আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। শুনেছি, দেশের অন্যতম শিল্পপতি এস আলমের বড়ভাই পর্যন্ত আইসিইউর সুবিধা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন! আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কেন যুক্ত করা হলো না? কাদের স্বার্থে এটাকে গুটিকয় হাসপাতালের মধ্যে সীমিত করে রাখা হয়েছে? আপনি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনো হাসপাতালেই রোগী নেই। অথচ অন্যদিকে বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই ৮০ শতাংশ সিট খালি পড়ে আছে! সরকারি বাধা না থাকলে তারা অনেকেই নিজেদের হাসপাতালকে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে পারতো। সেটা হলে কোভিড রোগীরা তাদের পছন্দের হাসপাতালে অনেক সহজে চিকিৎসা নিতে পারতেন। কিন্তু সেটা হয়নি। হাজার হাজার করোনা আক্রান্ত রোগী এখনো আইসিইউর সেবা থেকে বঞ্চিত। করোনা আক্রান্ত রোগীদের আইসিইউ সুবিধা লাগলে তারা কোথায় যাবে? কোথাও সেই সুবিধা তেমন নেই।

এবার আসি কোভিড সাসপেক্টেড রোগী প্রসঙ্গে।
দেশে এখন দু'ধরনের হাসপাতাল আছে।
কোভিড ও নন-কোভিড।

কোভিড আক্রান্ত কিছু রোগী সেবা পেলেও নন-কোভিড রোগীদের সেবা পেতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এই রোগীরা কারা? যেসব রোগীর কার্ডিয়াক সমস্যা আছে এমন রোগীরাই কেবল নন-কোভিড হাসপাতালে ভর্তির হতে পারছেন।

কিন্তু যাদের জ্বর, ডায়ারিয়া, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা আছে, তাদের সকলকেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মুখে পড়তে হচ্ছে। এগুলো যেহেতু করোনারও লক্ষণ ফলে না কোভিড হাসপাতাল, না নন-কোভিড হাসপাতাল কোথাও এমন ধরনের রোগীকে ভর্তি নিচ্ছে না। অথচ সংখ্যায় তারাই বেশি।

কারোর শরীরে ইনফেকশন থাকলে তার দেহে টেম্পারেচার থাকাই স্বাভাবিক। আবার ফুডপয়জনিঙের কারণেও কারোর ডায়ারিয়া হতে পারে। ডায়ারিয়া বা পেটের ব্যথাও করোনার অন্যতম লক্ষণ। এসব লক্ষণ থাকলে কোভিড ও নন-কোভিড কোনো হাসপাতালেই সিট মিলছে না। তাহলে এসব রোগী কোথায় যাবেন?

স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যারা জড়িত তারা এসব কেন ভাবলেন না? নাকি, তারা জানতেন সবই, কিন্তু এর পেছনে ছিলো অন্য কোনো উদ্দেশ্য? কেন কোভিড সাসপেক্টেড রোগীদের কথা, তাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা বিবেচনায় আনা হলো না- এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?

আমার প্রস্তাব মাত্র দুটো।
এরইমধ্যে আমরা অসংখ্য মানুষকে হারিয়েছি, যারা উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবেই আসলে মারা গেছেন। হাসপাতাল আছে, ডাক্তার আছে- তারপরেও চিকিৎসার অভাবে কিংবা যথাযথ ও উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসার অভাবে যদি কেউ মারা যান তবে তা এক অর্থে হত্যাকাণ্ডই।

আমি মনে করি, দুটো পদক্ষেপ যতো দ্রুত সম্ভব নেয়া দরকার-

এক. যতো দ্রুত সম্ভব বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করার সুযোগ অবারিত করে দেয়া। কেউ না চাইলে সরকার পছন্দের কিছু হাসপাতালকে 'একোয়ার' করে নিতে পারে এবং কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে।

দুই. কোভিড সাসপেক্টেড বা করোনার লক্ষণ আছে এমন রোগীদের যাতে কেউ ফেরত দিতে না পারে তার জন্য কঠোর নির্দেশ জারি করা।

এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নন-কোভিড হাসপাতালে দুটো উইং রাখার নির্দেশ জারি করা যেতে পারে।
১. নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, ২. কোভিড সাসপেক্টেড বা করোনার লক্ষণ আছে, এমন রোগীদের চিকিৎসা।
করোনার লক্ষণ থাকলে সেসব রোগীর দ্রুত করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা করা এবং করোনা হলে তাদেরকে দ্রুত কোভিড হাসপাতালে শিফটের ব্যবস্থা করা।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই এতোদিনে অনুধাবন করে থাকবেন যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও আমলারা এখনো আপনার নির্দেশনার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। অপেক্ষা করেন, কখন আপনি নিজে কোনো নির্দেশনা দেবেন! তারা ঠিকমতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে এবং সময়মতো আপনার কাছে হাজির করতে পারলে কতো সমস্যাই না দূর করা সম্ভব হতো!
আমরা আশা করি, এটুকু আপনি বুঝবেন যে করোনা না থাকলেও ভর্তিযোগ্য একজন সাধারণ রোগীর শ্বাসকষ্ট, পেটের অসুখ কিংবা সাধারণ ফ্লু বা ইনফেকশনজনিত জ্বর থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এমন রোগীরা তাহলে কোথায় যাবে?

বিষয়টা ব্যক্তিগত তবু তা আপনাকে না জানিয়ে পারছি না। আর, এর জন্য দায়ী আপনি নিজেই। আপনার চরিত্রের মধ্যে আছে মমতাময়ী একজন মা ও বোনের চিরাচরিত স্বভাব ও গুণাবলি। সে কারণেই ব্যক্তিগত এই ঘটনাটির কথা বলার লোভ সামলানো গেলো না।

আমার মায়ের করোনার লক্ষণ থাকায় ঢাকার কোনো বেসরকারি হাসপাতালই তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি! অনেক যোগাযোগ ও চেষ্টার পর গত শুক্রবার রাতে তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করাতে সক্ষম হই। সত্যি বলতে, সেদিন সামান্য ওই চিকিৎসাটুকু দিতে না পারলে আমার মাকে হয়তো সেদিনই হারাতে হতো। কারণ তাকে খুবই গুরুতর অবস্থায় বারডেমে নেয়া হয়! এ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এটুকুতে রাজি না হলে কী অবস্থা হতো, আপনি ভাবুন একবার।
এর মধ্যে তার অবস্থা আরো খারাপ হলে তাকে আইসিইউতে রেফার করা হয়। কোভিড সাসপেক্টেড হওয়ায় তাকে বারডেমের আইসিইউতে শিফট করতে কর্তৃপক্ষ রাজি হননি। আমরা অন্য কোনো নন-কোভিড হাসপাতালেও তাকে আইসিইউর একটা বেড দিতে রাজি করাতে পারিনি! উপায়ান্তর না দেখে কোভিড হাসপাতালগুলোতেও আমরা চেষ্টা চালাই। কিন্তু সেসব হাসপাতালের একটি আইসিইউতেও খালি বেড নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে!

আপনিই বলুন, আমার মাকে তাহলে কোথায় নেবো? বহু দেনদরবারের পর এবং প্রায় ২৪ ঘণ্টা চেষ্টা চালানোর পর আমার মাকে অবশেষে আমাদের এক পরিচিত হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু করোনা সাসপেক্টেড হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার একটি স্যাম্পল করোনা টেস্টের জন্য পাঠিয়েছে। আগামীকাল করোনা টেস্টের ফলাফল পজেটিভ এলে এই হাসপাতাল থেকেও বিদায় নিতে হবে।
তখন আমরা কোথায় যাবো? কোথায় আমার মায়ের চিকিৎসা হবে?
এর জবাব কে দেবেন?

এই লেখাটি যখন লিখছি, তখনই জানতে পারলাম, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও কোভিড ও নন-কোভিড উভয় ধরনের রোগীদেরকেই স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন এ নির্দেশ যাতে যথাযথভাবে পালিত হয় সেটা মনিটর করা দরকার। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ও কোভিড সাসপেক্টেড রোগীদের চিকিৎসায় যাতে কোনো গাফিলতি না হয় সেটাও মনিটর করা দরকার। একইসঙ্গে যতোদিন এ নির্দেশনা পালিত না হচ্ছে, ততোদিন যাতে অন্তত কোভিড সাসপেক্টেড রোগীদের চিকিৎসাবঞ্চিত হতে না হয় সেটাও মনিটর করা দরকার।

আমি বিশ্বাস করতে চাই, আপনি আমার এ লেখাটি পড়বেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন যাতে আর কোনো মানুষের মা-বাবাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।
আপনি আমার অশেষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানবেন।

লেখক: কবি ও জনসংযোগকর্মী এবং সাবেক সংবাদকর্মী।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর