‘মুজিব ভাই, আমি বাড়ি পাওয়ার জন্য রাজনীতি করি নাই’

‘মুজিব ভাই, আমি বাড়ি পাওয়ার জন্য রাজনীতি করি নাই’

ড. মো. আওলাদ হোসেন

ছবির ব্যক্তিটিকে আওয়ামী লীগের পুরনো নেতাকর্মীরা সকলেই নিশ্চয়ই চেনেন। আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, আওয়ামী লীগ ঘরানার একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছবিটি পাঠিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ‘পোস্টার নুরুল ইসলাম ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।

আমার খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তি। তাঁর মুখে শুনেছি, বঙ্গবন্ধুর সাথে একই ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিনি নির্লোভ, একজন সাদা মনের মানুষ। তিনি চিরকুমার ছিলেন।
পশ্চিম ধানমন্ডিতে একটি পুরানো বিল্ডিং-এর দোতলায় অবস্থিত দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাসায় থাকতেন। তিনি আমার সাথে অনেক ব্যক্তিগত কথা বলতেন।  

তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি উপহার দিতে চেয়েছিলেন। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “মুজিব ভাই, আমি বাড়ি পাওয়ার জন্য রাজনীতি করি নাই”। তিনি বাড়িটি নেননি। মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই তাঁর খোঁজ নিতেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, ২০০৮ এ ক্ষমতায় আসার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম ভাইয়ের জন্য প্রায়ই আর্থিক সাহায্য পাঠাতেন। আরও শুনেছি, ওই অর্থ নুরুল ইসলাম ভাই পাননি। হয়তো, যার মাধ্যমে পাঠাতেন, তিনি লোভ সামলাতে পারেননি।  

এটাও লোকমুখে শোনা বহুল প্রচলিত বঙ্গবন্ধুর আমলের একটি গল্পের মত। সত্য মিথ্যা জানি না। শুনেছি, একজন লোক গ্রাম থেকে এসেছেন। উপহার হিসাবে কিছু সবজি এনেছেন। একজন কর্মচারী সবজিগুলো নিয়ে দোতলায় গেলেন। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বলছিলেন। কর্মচারিটি সবজি নিয়ে আসা মেহমানের কথা বঙ্গবন্ধুকে বললেন। বঙ্গবন্ধু যেহেতু টেলিফোনে ছিলেন, তাই তিনি কোন কথা না বলে পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে দিলেন এবং ইশারায় বোঝালেন ঐ মেহমানকে সম্মানী দিয়ে আতিথেয়তা করার জন্য। কর্মচারীটি নীচে চলে গেলেন। টেলিফোনে কথা শেষে বঙ্গবন্ধু নীচে গেলেন মেহমানের খোঁজ নেওয়ার জন্য। মেহমান বঙ্গবন্ধুকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, “মুজিব ভাই, আমিতো সবজি এনেছি আপনাকে উপহার দেওয়ার জন্য। আপনি দাম দিলেন কেন? আপনার ১০ টাকা ফিরিয়ে নেন”। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ২০ টাকা দোতলা থেকে একতলা এসে ১০ টাকা হয়ে গেল।  
নুরুল ইসলাম ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনার বাসায় আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে এবং উনার শোয়ার ঘরেও আমি গিয়েছি। কড়কড়া মাড় দেওয়া ইস্ত্রী করা সাদা পাঞ্জাবি পরতেন। শোয়ার ঘরে একটি আলনা ছিল। পাঞ্জাবিটা খুলে ঐ আলনার উপর রাখতেন। আবার বের হওয়ার সময় ওটাই গায়ে দিতেন। বিছানায় গায়ে দেওয়ার জন্য একটি সুন্দর নকশিকাঁথা দেখেছিলাম। এমনভাবে ছিল, মনে হচ্ছিল এইমাত্র কেহ ঘুম থেকে উঠে গেল, এখনই ঘুমাতে যাবেন। একজন ছুটা কাজের বুয়া ছিল রান্না করার জন্য। একদিন রান্না করে, দু’দিন খেতেন। তিনি নিয়মিত ধানমন্ডি ৩ নং রোডে মাননীয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে আসতেন। দপ্তর সম্পাদকের টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়তেন। খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেক স্মৃতির কথা বলতেন। নেত্রী যখন ঐ কার্যালয়ে আসতেন, আমাকে বলতেন, “আমি নেত্রীর সাথে কথা বলবো”। নেত্রীও উনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলতেন। নেত্রীর রুম থেকে বের হওয়ার পর, উনার চেহারায় আনন্দের ছাপ ভেসে উঠতো।  

২০১৫ সালের গোড়ার দিকে, সঠিক দিন/তারিখ স্মরণে নেই, তিনি আমাদের মাঝ থেকে নীরবে চলে গেছেন, না ফেরার দেশে। চাঁদপুরের মতলবে উনার গ্রামের বাড়ির গোরস্থানে নিভৃতে ঘুমিয়ে আছেন। বর্তমান হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের ভীড়ে এমন নিবেদিত প্রাণ নির্লোভ আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মী পাওয়া দুর্লভ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, বাঙালীর মুক্তির জন্য ইহলোকে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। হে পরম করুনাময় আল্লাহ, পরলোকে উনাকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।

লেখক : কৃষিবিদ, পরিবেশবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর