১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহী গণঅভ্যুত্থান, প্রতিবিপ্লব নাকি আরেকটি ‘coup d’état’?

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহী গণঅভ্যুত্থান, প্রতিবিপ্লব নাকি আরেকটি ‘coup d’état’?

আবু আলম

তাহের, তাহের বলে ডাক দিই, ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ,

কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ-বাতাস।
বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ। '– অসীম সাহা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ জুলাই একটি কালো দিন। ১৯৭৬ সালে আজকের মতই শ্রাবণধারায় ভেজা এই দিনে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে পা হারানো একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম বীর সেনানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)-কে তারই মুক্ত করা স্বদেশভূমিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

 

ক্ষুদিরাম বসু, সূর্যসেনের সঙ্গে আরেকটি নাম যুক্ত হয়- কর্নেল আবু তাহের। কর্নেল তাহের সময়ের সাহসী পুরুষ, অকুতোভয়, আত্মত্যাগী এক বীর। তাঁর মত ও পথ, বিপ্লবের ভাবনা, রণনীতি ও রণকৌশল নিয়ে আমাদের অনেকের ভিন্নমত আছে এবং তা থাকতেই পারে।
তাহেরে কাছে 'স্বাধীনতা' শব্দটির অর্থ ছিল মানুষের সামগ্রিক মুক্তি।

মুক্তিকামী নিপীড়িত বাঙালী জাতির মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীসহ পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।  

আবু তাহের ময়মনসিংহ এবং রংপুরের একাংশ নিয়ে গঠিত ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ঔপনিবেশিক শোষণমুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত একটি জনযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে, নিরাপদ স্থানে বসে নির্দেশ প্রদান করেননি। একাত্তরের ১৪ নভেম্বর ঐতিহাসিক কামালপুরের যুদ্ধে নেতৃত্বদান করার সময় পাকসেনাদের গোলার আঘাতে তিনি মারাত্মক আহত হন। পরবর্তীকালে তার বাম পা কেটে ফেলতে হয়। আর তাই ক্রাচে ভর দিয়েই চলাফেরা করতেন কর্ণেল আবু তাহের।

আবু তাহের ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সাহসী এই অফিসারকে ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে (কমান্ডো বাহিনী) বদলি করা হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে প্রথমে কাশ্মীর ও পরে শিয়ালকোট রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের জন্য একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তাকে ‘মেরুন প্যারাস্যুট উইং’ নামক সম্মাননা প্রদান করা হয়।  

১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তিনি আমেরিকার ফোর্ট ব্রাগ ও ফোর্ট বেনিং-এ গেরিলা যুদ্ধের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং উচ্চতর সমরবিদ্যায় অনার্স গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে সিনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে স্টাফ কলেজ ত্যাগ করেন।

চিকিৎসা শেষে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আবু তাহেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ঐ বছর জুন মাসে তিনি ৪৪তম ব্রিগেডের অধিনায়ক ও কুমিল্লা সেনানিবাসের অধিনায়কের দায়িত্ব লাভ করেন। সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তৎকালীন সরকারের সাথে মতপার্থক্য হলে ৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

স্বাধীনতার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক কায়দায় গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী স্বাধীন দেশের উপযোগী হতে পারে না। স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি আমলাতান্ত্রিক, উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন, শাসকের হাতিয়ার বাহিনীর ঔপনিবেশিক কাঠামো ভেঙে জনতার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় বসেন। সেই সময় তাহেরকে বেশ কিছু লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়। তাহের সেগুলো প্রত্যাখান করেন। ফারুক-রশিদের পছন্দেই ২৪ আগস্ট (১৯৭৫) জিয়াকে সেনাপ্রধান এবং তাওয়াবকে বিমান বাহিনী প্রধান নিয়োগ দেন মোশতাক। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে গুটিকয়েক মেজরের বঙ্গভবনে অবস্থান এবং দেশ পরিচালনা নিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়।  

‘অপারেশন প্যান্থার’ নামে আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঁচাত্তরের তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন। সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়। অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিন বলেছেন- অপারেশন প্যান্থারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ওই অভ্যুত্থানের শেষলগ্নে খোদ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে আরেকটি অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন।  

৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

৩, ৪, ৫, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ দেশে কার্যত কোনও সরকার ছিল না। আদালতে দেওয়া তাহেরের জবানবন্দী এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানা যায়- তিন তারিখে তাহের অসুস্থ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জের বাসায় ছিলেন। ভোর চারটার দিকে জিয়া টেলিফোন করে সাহায্য চান। বেশ কিছু সিপাহি, এন.সি.ও. ও জে.সি.ও. তার নারায়ণগঞ্জের বাসায় হাজির হন। তিনি তাদের কয়েকজনের সঙ্গে শোবার ঘরে কথা বলেন।  

সিপাহি, এন.সি.ও. ও জে.সি.ওদের মধ্যে এমন একটি ধারণা চাউড় হয়েছিল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পেছনে ভারতীয়দের হাত রয়েছে। বাকশাল ও তাদের সহযোগীরা ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে নেমেছে। খালেদের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকায় একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়।  

১৫ আগস্টের পর এটিই ছিল ঢাকার প্রথম মিছিল। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফুল দেয়। এই মিছিলে অনেকের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের মা এবং ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ।

৪ নভেম্বর বিকেলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তাহেরের কাছে খবর পাঠান। জিয়ার অনুরোধ ছিল তাহের যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তাকে মুক্ত করে। রাজনৈতিক রণকৌশলের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ গড়ে তোলা হয়।  

সেই সময়ে সেনানিবাসে জাসদের অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যথেষ্ট শক্তি ছিল না। ঊর্ধতন সেনা কর্মকর্তারা তাহেরের জনতার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নে বিশ্বাস করতেন না। তারা প্রচলিত ঔপনিবেশিক ধারা টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন। ছিল পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সেনা সদস্যরা! তারপরেও পরিস্থিতি বিবেচনায় যোগাযোগ, আলোচনা ও মত বিনিময়ের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা দ্রুত প্রস্তুত করা হয়।  

৫ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা লিফলেট বিতরণ করে । ছয় নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়। ঢাকা সেনানিবাসের সব ইউনিট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সবাইকে সজাগ থাকতে ও পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে দেয়া হলো। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়। সাতই নভেম্বর ভোর রাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে।

কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে যখন ৭ নভেম্বর জাসদের গণবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়, তখন মোশতাক এবং ফারুক-রশিদকে সমর্থন যোগানো ট্যাংক ও গোলন্দাজ ইউনিটের সৈনিকরা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

 ফারুক-রশিদকে সমর্থন যোগানো অপর ইউনিট, দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিও অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। খুনি মেজরদের সহযোগী আর্টিলারি রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিন ফারুক-রশিদদের সঙ্গে দেশত্যাগ করেনি। ৭ নভেম্বর খালেদ-বিরোধী অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর এই মেজর মহিউদ্দিনই জেনারেল জিয়াকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অফিসে নিয়ে আসে।  

মোশতাকপন্থী অনেক সৈনিক খালেদ মোশাররফবিরোধী অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় জড়িত হয়। তারা কর্নেল তাহেরকে সমর্থন দিয়েছিল কেবল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, জাসদের পরিকল্পনামতো সেনাবাহিনীর কাঠামো বদলের বিপ্লবের জন্য নয়। অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ৭ নভেম্বর রাজপথে মোশতাকের ছবি নিয়ে লোকজন নামিয়ে দেওয়া হয়।  

শহীদ মিনারে এক সমাবেশে তাহের ও জিয়ার ভাষণ দেবার কথা ছিল। শহীদ মিনারে সমাবেশের সময় ঠিক করা হয় সকাল দশটায়। জিয়া শহীদ মিনারে আসতে অস্বীকৃতি জানান। শহীদ মিনারে জাসদের ডাকে সমবেত লোকজনের উপর গুলীবর্ষণ করে সেনাসদস্যদের একটি দল। পরদিন ৮ নভেম্বর বাইতুল মোকাররম এলাকার সমাবেশে হামলা চালায় আরেক দল সৈন্য। আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় সিপাহী গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন!

২৪শে নভেম্বর, ১৯৭৫-এর দুপুরে তাকে সহ কয়েকজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একজন সহকারী আবাসিক শিক্ষকের বাসা থেকে কর্ণেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি সেখানে তার সহযোদ্ধাদের সাথে সভায় বসেছিলেন। সভা শুরু হবার কয়েক মিনিট পর আমি সেখান থেকে অন্য একটি কাজে বেরিয়ে আসায় গ্রেপ্তার এড়াতে পারি সেদিনের জন্য।  

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক গোপন সামরিক প্রহসনের আদালত বসানো হয় তাহেরকে ফাঁসি দেবার জন্য। প্রহসনের আদালত বসানোর অংশ হিসেবে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ বলে আটক অনেক বন্দীকে অন্যান্য জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাকেও পাঠানো হয়েছিল যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।  

সেই গোপন সামরিক প্রহসনের আদালতে কর্ণেল আবু তাহেরের ফাঁসি এবং ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড জেল দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই। আদালতের প্রধান বিগ্রেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে পুরুস্কারস্বরূপ পরে সিভিল সার্ভিসে উচ্চপদে বসানো হয়। রায়ের মাত্র চার দিন পরই ২১শে জুলাই কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল নীলনকশা অনুযায়ী অত্যন্ত গোপনে তড়িঘড়ি করে।  

২০১১ সালের ২২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায় তাকে আবার প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করেছে। প্রমাণিত হয়েছে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া ও তা কার্যকর করা ছিল ঠান্ডা মাথায় খুন।

২০ জুলাই ১৯৭৬ সন্ধ্যায় কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা জানানো হয়। তাহের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দেন বার্তাবাহককে। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী একজন মৌলভি এসে তাহেরকে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বলেন। তাহের যা বিশ্বাস করতেন, তা বলতে দ্বিধা করতেন না।  

তাহের মৌলভির উদ্দেশে শুধু বলেন, ‘আপনাদের সমাজের কালিমা আমাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। কখনো না। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনি এখন যান। আমি এখন ঘুমাব। ’ 

এরপর তাহের সত্যি সত্যি ঘুমাতে যান এবং গভীর নিদ্রায় ডুবে যান। স্বাধীন বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বীর তাহেরের সেটাই ছিল শেষ ঘুম। ২১ জুলাই ভোররাত তিনটা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। ৮ নম্বর সেল। ঘুম থেকে তাহেরকে ডেকে তোলা হয়। উপস্থিত ব্যক্তিরা তাকে সাহায্য করতে চাইলে তাহের মৃদু স্বরে শুধু বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ শরীরে তোমাদের স্পর্শ লাগুক, আমি তা চাই না। ’ 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে তিনি দাঁত মেজে, দাড়ি কেটে, গোসল করে, নকল পা, জুতা, প্যান্ট, শার্ট নিজেই পরে নেন। আম কাটেন। নিজে খান, অন্যদের দেন। চা পান করেন। সিগারেট ধরান। তাহেরের প্রশান্তি দেখে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে পড়েন। সবাইকে উদ্দেশ করে তাহের বলেন, ‘সবাই এত বিষন্ন কেন? আমি দুদর্শাগ্রস্তদের মুখে হাসি উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। ’

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কর্নেল তাহের একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। সেই কবিতা লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের প্রয়াত সাব সেক্টর কমান্ডার এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তারই একটির অংশ-

“জন্মেছি সারাদেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম
জন্মেছি তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙবো বলে ভেঙে দিলাম
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করবো বলে করেই গেলাম
জন্ম আর মৃত্যুর বিশাল পাথর রেখে গেলাম
পাথরের নিচে শোষক আর শাষকের কবর দিলাম
পৃথিবী, অবশেষে বিদায় নিলাম। ”

আরও বলেছিলেন, নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোন বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিতে যাই। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক! দীর্ঘজীবী হউক স্বদেশ! ফাঁসি দেওয়ার আগে তাহেরের সর্বশেষ কথা ছিল, ‘লং লিভ মাই কান্ট্রিম্যান। ’

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থান বিষয়ে গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। আমরা জানি- তাহেরের ভাবনা আর পরিকল্পনা সফল হয় নি। অনেকের মাঝে নানান প্রশ্ন? কে দেবে সেগুলোর জবাব? 

জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লব নাকি আরেকটি ‘coup d’état’হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান তো ‘বিপ্লবে’ বিশ্বাস করতেন না। কেন তাহের জিয়াকে বিশ্বাস করেছিলেন! মাত্র ৪ দিনের প্রস্তুতিতে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া কি সঠিক ছিল! তবে এটাই সত্য- এর মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগ পেয়ে যায়।

প্রশ্ন- জাসদ কেন ৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থান নাকি আরেকটি ‘coup d’état’ জড়িয়ে পড়লো! ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে সুপরিকল্পিতভাবে জাসদ’কে জড়ানো হয় নাকি প্রস্তুতি ছাড়াই তারা যুক্ত হতে বাধ্য হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের রাজনৈতিক রণকৌশলে গণতান্ত্রিক জাতীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের নিপীড়িত শোষিত, বঞ্চিত মানুষদের অংশগ্রহণ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বিকাশিত করতে চেয়েছিল।  

গণঅভ্যুত্থান এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নির্ভর করবে নিপীড়িত শ্রেণীকে কতটুকু সংগঠিত করতে পারা যাবে তার উপর। গ্রামের ক্ষেতমজুর, ক্ষুদ্র চাষী, ভাগ চাষী এবং শহরের শ্রমিক শ্রেণি, নিম্নবিত্ত, ভুখা-নাঙ্গা গরিব মানুষেরা কতটুকু সংগঠিত হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে জাসদ নেতৃবৃন্দ গণঅভ্যুত্থানকে ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন।  

প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের চৈনিক মডেল নয়, বরং বলশেভিক ধাঁচের অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে যথার্থ বলে মনে করেছিলেন তারা। ছিল এপ্রিল থিসিস, জেনারেল গিয়াপ, চে গুয়েভারারও প্রভাব। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা, স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী, যুবক যোগ দেন জাসদে। লক্ষ কোটি মানুষ সমর্থন দিয়েছিল দলটিকে! 

বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আর সবশেষে ৭ নভেম্বরের সিপাহী অভ্যুত্থানে যুক্ত হবার পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তারপর কত তরুণ, যুবক, কৃষক, শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এই দেশ। কত মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে খানখান হয়েছে! কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ!

লেখক: সাবেক সচিব, স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর