পিস্তল ঠেকিয়ে জিসাকে ‘মৃত’ বানান এসআই!
আমাদের সময়ের প্রতিবেদন

পিস্তল ঠেকিয়ে জিসাকে ‘মৃত’ বানান এসআই!

অনলাইন ডেস্ক

নারায়ণগঞ্জের কিশোরী স্কুলছাত্রীকে ‘ধর্ষণের পর হত্যা’র রোমহর্ষক জবানবন্দি আদায় করতে মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার এসআই শামীম আল মামুন তিন আসামিকে ‘পিস্তল ঠেকিয়ে’ হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আসামিরা জীবন বাঁচাতে এবং নির্যাতন থেকে বাঁচতে পুলিশের শিখিয়ে দেওয়া ‘কথিত হত্যার’ রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।

জবানবন্দি দেওয়া তিন আসামির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ অভিযোগ করেন। এমনকি রিমান্ডে ব্যাপক মারধরের হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও করেন তারা।

এখন চাপে পড়ে এই অর্থ ফেরত দিতেও এসআই শামীম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

ঘটনার দেড় মাস পর গত সোমবার ‘মৃত’ স্কুলছাত্রী ফিরে আসার পর আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিশোরী স্কুলছাত্রী বলেছে তার অন্তর্ধানের বিষয়ে জবানবন্দি দেওয়া তিন আসামি মো. আবদুল্লাহ, রকিব ও নৌকার মাঝি খলিলুর রহমান কিছুই জানেন না। সে নিজেই ইকবাল নামে একজনের হাত ধরে চলে যায়।

তার সঙ্গেই দেড় মাস ছিল। তার দাবি ইকবালকে সে বিয়েও করেছে।  

তিন আসামির গ্রেপ্তার এবং জবানবন্দির বিষয়ে সে কিছু জানত না বলেও জানিয়েছে। ওই স্কুলছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তারাও বলেছেন, যে তিন আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন, তারা নির্দোষ। তবে তারা কেন জবানবন্দি দিল এই বিষয়টি তারা জানেন না।

আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আবদুল্লাহর মা শিউলি বেগম বলেন, 'আমার ছেলেকে অনেক টর্চার করা হয়েছে। পুলিশ তাকে বলেছে জবানবন্দি না দিলে আবার রিমান্ডে এনে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। আমার ছেলে কখনই এসব ঝামেলার মধ্যে যায়নি। সে জীবন বাঁচাতে স্কুলছাত্রীকে হত্যা করেছে বলে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা (পুলিশ) এমন মারা মেরেছে, আমার ছেলে পা সোজা করে দাঁড়াতে পারছিল না। দুই হাতে মারধর করেছে। শুধু জীবন বাঁচাতে জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছে। '

রকিবের ভাই মো. সজীব বলেন, 'আমার ভাইকে ব্যাপক মারধর করে পুলিশ। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছে জবানবন্দি না দিলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। সে ভয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এসআই শামীম আল মামুন আমাদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকাও নিয়েছে। টাকা না দিলে রিমান্ডে আরও বেশি মারধর করা হবে এই ভয়ও দেখানো হয়েছিল। '

জবানবন্দি দেওয়া আরেক আসামি খলিলুরের স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, 'আমার স্বামীকে ফাঁসানো হয়েছে। আমরা দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর পুলিশ ধরে নিয়ে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করেছে। '

এ বিষয়ে তখনকার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুন বলেন, ‘পিস্তল ঠেকিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, মারধর করা হয়েছে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কেন এই কাজ করতে যাব? তারা আমার শত্রু নাকি? এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসা করেন। ’ তিনি আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেন। পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।

ঘটনা তদন্তে সহায়তা করতে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদ আলম পারভেজের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি। যেসব প্রশ্ন উঠেছে, এগুলো নিয়ে কাজ করছি। তারা কেন জবানবন্দি দিল এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তাকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি জবানবন্দি আদায়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তা ছাড়া তিনি নিজেই ওই স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করেছেন। '

দায় নিচ্ছেন না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা : কল্পিত ঘটনা সাজিয়ে জবানবন্দি আদায়ের ঘটনার দায় নিতে চাচ্ছেন না মামলা তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। পুরো দায় এখন চাপানো হচ্ছে এসআই শামীম আল মামুনের ওপর। এমনকি নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসি আসাদুজ্জামান বলেছেন, তিনি এ ঘটনার বিষয়ে কিছু জানেন না। মামলা রেকর্ডের সময় তিনি ছুটিতে (৩ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট) ছিলেন। তাই এ দায় তার না। এ সময় থানার ওসির দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান।

এসআই শামীম আল মামুনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'শামীম কোনো অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে ছিল কিনা বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি যদি ব্যক্তিগতভাবে কোনো অনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে তার দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ নেবে না। এর তদন্ত হবে, বিচার হবে। '

এ বিষয়ে সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মেসেজ পাঠিয়েও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সদর থানাটি এ সার্কেলের অধীনে। এ সার্কেলের দায়িত্বে থাকা সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইমরান সিদ্দিকী বলেন, 'এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মামলার তদন্ত তদারকি করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন)। '

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,' মামলার তদন্ত তদারকির আমি এবং সার্কেল এএসপি করে থাকি। আর এ ঘটনায় আসামিদের যখন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, আমি পারিবারিক কাজে ছুটিতে ছিলাম। তাই বিষয়টি আমি তদারকি করিনি। '

কল্পিত ঘটনা যেভাবে : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিন আসামি আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তার ধারাবাহিকতা আছে। অর্থাৎ তারা তিনজনই বলেছেন ওই স্কুলছাত্রীকে নৌকায় করে ঘুরেছেন। রাত হলে তারা তিনজন ওই স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে। তার পর শ্বাসরোধ করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দিয়েছেন।

কল্পিত ঘটনায় তিন আসামি একই ধরনের জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে তিন আসামির পরিবার বলছে পুরো ঘটনাটি এসআই শামীম আল মামুনের মস্তিষ্কপ্রসূত। তিনি ‘হিরো’ হতে এই কথিত হত্যার নাটক সাজান। ঘটনার দিন (৪ জুলাই) আসামি আবদুল্লাহর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে ওই স্কুলছাত্রী বাসা থেকে বের হন। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুন প্রযুক্তিগত তদন্তে নিশ্চিত হন আবদুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলছাত্রী বাসা থেকে বের হন। তার পরই তিনি আবদুল্লাহ ও রাকিবকে গ্রেপ্তার করেন। পরে নৌকার মাঝি খলিলুরকে গ্রেপ্তার করেন। তিন আসামির পরিবারের সদস্যরা আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা কিছু জানেন না জানালেও শামীম আল মামুন ধারণা করেন, ওই স্কুলছাত্রীকে হত্যার পর লাশ গুম করেছেন। এ ধারণা থেকেই তিনি আদালতে জবানবন্দি দিতে আসামিদের চাপ প্রয়োগ করেন। আসামিরা চাপের মুখে তার শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য দিয়েছেন। এ কারণেই কল্পিত হত্যায় তিনজন আদালতে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

স্কুলছাত্রী যা বলল : ফিরে আসা স্কুলছাত্রী বলেছে আসামি আবদুল্লাহ তার বন্ধু। সে আবদুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার দিন বাসা থেকে বের হয়। রাত হয়ে যাওয়ার পর আবদুল্লাহ খাবার আনতে যাওয়ার কথা বলে তাকে ফেলে চলে যায়। পরে একটি মোবাইল ফোনের রিচার্জের দোকান থেকে তার প্রেমিক ইকবালকে ফোন করে। পরে ইকবাল এসে তাকে নিয়ে যায়। দেড় মাস ধরে সে ইকবালের সঙ্গেই ছিল। তারা একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছিল। গত সোমবার কিছু টাকা চেয়ে সে তার মাকে ফোন করে। পরে তার মা পুলিশ নিয়ে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে আসে।

উল্লেখ্য, ওই স্কুলছাত্রী নিখোঁজ হয় গত ৪ জুলাই। ঘটনার এক মাস ২ দিন পর ৬ আগস্ট দুজনকে আসামি করে মামলা করে স্কুলছাত্রীর পরিবার। এ ঘটনায় ৯ আগস্ট তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা স্কুলছাত্রীকে হত্যার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেন। গত সোমবার ওই স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করে পুলিশ।

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল