মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ কোরআনুল কারিমের সুরা হাদিদের ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন খেলতামাশা ও প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। ’ এ আয়াতের শেষে দুনিয়ার জীবনকে ‘মিথ্যা ভোগবিলাস ছাড়া কিছুই নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হায়! ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য কি পাগলের মতোই না ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ। দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, দুপুর নেই চলছে মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা।
চলতে চলতে একটা সময় মানুষ হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করে অন্য এক মানুষরূপে। শৈশবের হাসিখুশি মানুষটি আজ যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শৈশবের সেই নির্মল-শুদ্ধ আত্মাটি আর নেই। পাপের ধুলোয় শুদ্ধ আত্মা বড় বেশি কদাকার হয়ে গেছে।ফেরেশতার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে এবার টনক নড়বে তার। মনে পড়বে বহুবার সে মৃত্যু নামক শব্দটি শুনতে শুনতে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার বাবা, মা, ভাই, বোন কত প্রিয়জনকে সে মাটির নিচে চাপা দিয়ে এসেছে! এবার সে বুঝতে পারবে তারও সময় এসে গেছে। যখনই সে বুঝতে পারবে তাকে মরতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ভিতর জগতে এক ধরনের ভয়ঙ্কর ঝড় তার আপাদমস্তক কাঁপিয়ে তুলবে। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দাকায়েকুল আখবার’ -এ লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ফেরেশতা যখন বান্দাকে প্রস্তুত হওয়ার কথা বলবে, বান্দা তখন আজরাইলকে দেখে ভয়ে অসাড় হয়ে পড়বে। মূলত আজরাইল ফেরেশতার বিকট আকৃতিই তার ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় অপেক্ষা করছে মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য। ’ ইমাম গাজ্জালি বলেন, ‘মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে স্বয়ং মৃত্যু এসে বীভৎস আকৃতি নিয়ে দাঁড়াবে। ’ মৃত্যুর আকৃতি সম্পর্কে দার্শনিক গাজ্জালি লেখেন, ‘আল্লাহ মৃত্যুকে সৃষ্টি করে ৭০ হাজার শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। মৃত্যুর পাখা ছিল ৭০ হাজার। এক পাখা থেকে আরেক পাখার দূরত্ব ছিল ৭০ হাজার মাইল। এত বিশাল বস্তুটির পাশ দিয়ে যখন ফেরেশতারা যেত তখন হতভম্ব হয়ে ভাবত জিনিসটা কী?’
যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হলো ও আজরাইলের কাঁধে প্রাণিকুলের মৃত্যুর দায়িত্ব পড়ে, তখন আজরাইল বললেন, ‘হে আল্লাহ! মৃত্যু জিনিসটা কী?’ আল্লাহ মৃত্যুকে ডেকে বললেন, ‘হে মৃত্যু! আমি তোমার শিকলগুলো খুলে দিলাম। এবার তুমি তোমার পাখা নিয়ে উড়তে থাকো। ’ সেদিন জিবরাইল, ইসরাফিল, মিকাইলের মতো ফেরেশতার পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র মনে হলো। অনেক সময় ওড়ার পর যখন মৃত্যু থামল, তখন দেখা গেল সব ফেরেশতা অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন। গাজ্জালি লেখেন, প্রায় ২ হাজার বছর এভাবেই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। হজরত জিবরাইল ফেরেশতা প্রথম মাথা তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আর কিছু কি এত মহান তোমার সৃষ্টিতে আছে? আল্লাহ বললেন, তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সবকিছুর চেয়ে বড় এবং মহান। এমন বিকট আকৃতির মৃত্যু যখন মানুষের সামনে এসে দাঁড়াবে, মানুষের আত্মা তখন ভয়ে এখানে-ওখানে পালানোর চেষ্টা করবে। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা বলবে, আজ কোথায় পালাবে তুমি? পৃথিবীতে তুমি ছিলে সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। তোমার ভয়ে মানুষ থরথর করে কাঁপত। তুমি মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে না। দুর্নীতির কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় তুমি গাড়ি-বাড়ি সবই করেছ। আজ তোমার টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ি কোনো কিছুই তোমাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারবে না। আজ তুমি কোথাও পালাতে পারবে না। এমন সময় বিরাট আকৃতির মৃত্যু মুমূর্ষুকে উদ্দেশ করে বলবে, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে দেখ, আমি সেই মৃত্যু! যার স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। আমি সেই মৃত্যু! যে তোমার থেকে তোমার বাবা-মাকে কেড়ে নিয়েছি। এখন আবার তোমার সন্তানদের থেকে তোমাকে কেড়ে নেব। আমি সেই মৃত্যু! যে কোটিপতি-ফকির দুজনের সঙ্গে সমান আচরণ করি। আমি সেই মৃত্যু! যে রাষ্ট্রপ্রধান আর রাষ্ট্রদ্রোহী সবার সঙ্গে সমান আচরণ করি। আমি সবাইকে মৃত্যুর যন্ত্রণাদায়ক স্বাদ আস্বাদন করাই।
তারপর মৃত্যু বলবে, আল্লার বান্দা! আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার ব্যাপারে তোমার কাছে হাজারো সতর্কবাণী উপস্থাপন করা হয়েছিল। যখন তোমার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-পড়শি কারও মৃত্যু হতো, তখন তোমাকে সাবধানবাণী পাঠানো হতো- একদিন তোমাকেও মরতে হবে। আফসোস! মৃত্যু দেখে তুমি নিজের মৃত্যুর জন্য সাবধান হওনি। আজ তোমাকে খালি হাতে অপ্রস্তুতভাবে চলে যেতে হবে মহান মাবুদের দরবারে। এভাবে যখন মৃত্যু তাকে ধমকাতে থাকবে তখন সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলবে, হে আমার আল্লাহ! আপনি আমাকে আর একটিবার সুযোগ দিন, তাহলে আমার সব সম্পদ আপনার রাস্তায় দান করে দেব। আমার বাকি জীবন আপনার রাস্তায় কাটাব। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা আয়াত শুনিয়ে দেবে, ‘যখন কারও সময় এসে যায়, তখন আর এক মুহূর্ত আগে বা পরে করার সুযোগ নেই। ’
লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন
আরও পড়ুন: করোনাকে হেলা নয়
নিউজ টোয়েন্টিফোর/নাজিম