দলিত সাহিত্য মানে কী ?

দলিত সাহিত্য মানে কী ?

তসলিমা নাসরিন

একবার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছি। হঠাৎ একদল নারী পুরুষ আমাকে দেখে ছুটে এলেন, কী, আমার সঙ্গে ফটো তুলবেন। নিজেরাই বললেন তাঁরা দলিত সাহিত্যিক। সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে দলিত সাহিত্যের ওপর একটি অনুষ্ঠান ছিল, কিছু দলিত সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম দলিত সাহিত্য মানে কী? আপনারা দলিতদের নিয়ে লেখেন, নাকি আপনারা দলিত? ওঁরা বললেন, ওঁরা দলিত। মনে হচ্ছিল, দলিত বলে ওঁদের আনন্দ হচ্ছে, কারণ দলিত বলেই সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে আমন্ত্রিত হওয়ার, পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ ওঁরা পেয়েছেন।

ওঁরা নিজেদের টেবিলে ফিরে যাওয়ার পর আমি ভাবতে বসলাম দলিত সাহিত্য, দলিত সাহিত্যিক এ কেমন জিনিস, দলিতদের মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। এককালে বাংলার কিছু মুসলমান 'মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা' প্রকাশ করতেন।

সেটিও ছিল চরম বিদঘুটে। সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের সব ভাষা, এমনকী অসংখ্য ছোট ছোট প্রায়-মৃত ভাষার সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা হয়, সেটি, আমি মনে করি, ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দলিত সাহিত্যিকদের আলাদা করলে ব্রাহ্মণ সাহিত্যিক, কায়স্থ সাহিত্যিক, বৈদ্য সাহিত্যিকদেরও আলাদা করতে হয়! শুনেছি দলিতরা দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির দাবি করছেন। দলিত অ্যাকাডেমি যদি গড়ে তোলা পলিটিক্যালি কারেক্ট, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ে তোলাও পলিটিক্যালি কারেক্ট। কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠীও তাঁদের বঞ্চনার কিছু না কিছু কাহিনী সামনে আনতে পারেন। এ কথা ঠিক দলিতদের শিক্ষা থেকে দীর্ঘকাল বঞ্চিত করা হয়েছে, সাহিত্য রচনায় তাঁরা হয়তো পিছিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁদের সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য বলে যেন উপেক্ষা না করা হয়, সেটি দেখার দায়িত্ব সাহিত্য অ্যাকাডেমির। আলাদা অ্যাকাডেমি হলেই যে সাহিত্যের মান বাড়বে তা তো নয়। আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ার পেছনে যত না সাহিত্যিক কারণ, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণ।

আরও পড়ুন: মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা

সাহিত্যের বিচার সাহিত্য দিয়েই হওয়া উচিত। সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, শূদ্র সাহিত্য, বা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সাহিত্যে ভাগ করলে এ শুধু সাহিত্যিকদের অপমান নয়, সাহিত্যেরও অপমান। ভাগের কোনও শেষ নেই। বড় গোষ্ঠী থেকে ছোট গোষ্ঠী, ছোট থেকে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর -- ভাগ হতেই থাকবে। তার চেয়ে সব বিভেদকে দূরে সরিয়ে এক হয়ে যাওয়া ভালো। সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রেই তো বিভেদের কোনও স্থান নেই। জাতপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও এই প্রথা মানার লোকের অভাব নেই সমাজে। সমাজকে সুস্থ সুন্দর করার দায়িত্ব তো কিছুটা সাহিত্যিকেরও।

আরও পড়ুন: ধর্ম নিয়ে যা বললেন তসলিমা নাসরিন

জাতপ্রথার ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকরাই সচেতন করেছেন। সাহিত্যিকদের একটিই পরিচয়, তাঁরা সাহিত্যিক। দলিতদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি এভাবে সাহিত্যকে গোষ্ঠীভুক্ত করা অনুচিত। সাহিত্য হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, তথাকথিত ছোটজাত বড়জাত , মুসলমান, নাস্তিক, ধনী গরিব, কালো সাদা বাদামি, নারী পুরুষ যে-ই লিখুন না কেন, যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, তাকে 'সাহিত্য' হিসেবে দেখতে হবে। নামদেও ধাসাল, মীনা কান্দাসামি, উর্মিলা পাওয়ার, বাবুরাও বাগুলদের আমরা 'দলিত লেখক' বলি না, আমরা তাঁদের 'লেখক' বলি। মেয়েদের লেখা সাহিত্যকেও মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে পৃথক করার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র আমরা দেখেছি। ভার্জিনিয়া উলফ, টনি মরিসন, মার্গারেট এটউড,এলিস ওয়াকার এঁদের আমরা 'লেখক' বলি, 'মহিলা লেখক' বলি না।

(ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত)

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর