সাত মাস, কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না, বাইরে যাচ্ছি না

সাত মাস, কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না, বাইরে যাচ্ছি না

তসলিমা নাসরিন

সাত মাস আমি ঘরের বার হচ্ছি না, ঘরে কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছি না। সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করছি। কী করে পারছি? পারছি কারণ এক যুগ আমি ইউরোপে ছিলাম। ইউরোপে বাস করার সুফল এটাই, কোনও কিছুর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করার দরকার হয় না।

একাই সব কাজ এমনকী নোংরা কাজ বলে যে কাজগুলোকে ভাবা হয়, যেমন টয়লেট পরিস্কার, ডাস্টবিন পরিস্কার, বেড়াল কুকুরের গু-মুত পরিস্কার, কোনওরকম নাক না সিঁটকে করে ফেলা যায়। ঘর ঝাড়ু দাও ঘর মোছো বাসন মাজো কাপড় কাচো-- কিছুতে তো অনীহা নেই।

একবারও তো মনে হয় না, এই কাজগুলো গরিব লোকের কাজ, আমাদের কাজ খাটে বসে বা সোফায় বসে আরাম করা? এই যে গরিব লোকদের মানুষ বলে মনে করা, তাদের সমীহ করে কথা বলা, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া, এটি আমার মনে হয় না ইউরোপে দীর্ঘকাল না কাটালে সম্ভব হতো।

সমতার সমাজে বাস করলে সমতা অনুশীলন করতে হয়, ওই করতে করতেই একসময় চরিত্রে গেঁথে যায় সমতার বোধ।

শুধু বই পড়ে, সমতা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেই সমতার জীবন যাপন করা যায় না।


আরও পড়ুন: কুকুরের জন্য ভালোবাসা


সমতার দিশি পণ্ডিতদের দেখেছি গরিবদের তুই তোকারি করতে, চাকরবাকরদের সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করতে। বাঙালি পুরুষ যারা কোনওদিন রান্নাঘরে ঢোকেনি, কী চমৎকার এক একজন রাঁধুনী বনে যায় বিদেশে গিয়ে। দেশে বাস করলে তারা লজ্জা পায় রান্না করতে, কারণ রান্না তো মেয়েদের কাজ, ছোটলোকদের কাজ! কিন্তু বিদেশ-জীবনে তারা গর্ব করে বলে তারা কী কী রান্না জানে, তারাও ঘরবাড়ি পয় পরিস্কার করাটা লজ্জার বলে মনে করে না।  

ইউরোপ কতদিন তাদের আদর্শ সমাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে জানি না। তবে ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও যতটুকুই গড়েছে ওরা, তারই স্পর্শে আমাদের চরম বৈষম্যে ঠাসা নষ্ট ভ্রষ্ট পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষগুলো সবটা না হলেও কিছুটা মানুষ তো হয়েছে। কিছুটা উপকৃত তো আমিও হয়েছি।

লেখক: তসলিমা নাসরিন (ফেইসবুক থেকে)