এইসব ছেলে-পেলে এমন ধর্ষক হয়ে উঠছে কেন?

এইসব ছেলে-পেলে এমন ধর্ষক হয়ে উঠছে কেন?

আমিনুল ইসলাম

সিলেট শহর। যে শহরে আমি জীবনের আট'টা বছর কাটিয়ে এসছি। এটি আমার সেকেন্ড হোম।  

সেই সিলেটে একটা মেয়ে তার স্বামী'র সাথে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষিত হয়েছে।

মেয়েটাকে স্বামী'র সামনে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাদ বাকী ঘটনা সবার'ই জানা।  

সিলেটের এমসি কলেজে পড়েছে, এক ছেলে আজ একটা স্ট্যাটাস লিখেছে। জানেল নামের এই ছেলেটার পোস্ট আমি পুরোপুরি তুলে দিচ্ছি।

সে হয়ত অতো'টা গুছিয়ে লিখতে পারেনি। কিন্তু আমি লেখাটা যেভাবে আছে, সেভাবেই তুলে ধরতে চাইছি। নইলে লেখাটা আবেদন হারাবে। "মাফ করবেন।

গতকাল এমসি কলেজে যেটা হয়েছে এরকম হাফ ডজন ঘটনা আমি জানি। এমসি কলেজে ভর্তির দিন থেকেই এইসব শুনে আসছি,দেখে আসছি।  


আরও পড়ুন: ড্রাইভার মালেকের স্বাস্থ্য ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট


ভিসি বাংলো রোড,ছাত্রী হোস্টেলের বামপাশের পাহাড়,শহীদ মিনার রোড,কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের পিছনে সব জায়গাতেই এমন হয়ে আসছে। আমি যেহেতু রাজনৈতিক ছেলেপেলেদের সাথে বেশি মিশতাম তাই এসব জায়গায় কারা কি করতো আমার মুটামুটি জানা।

ক্যাম্পাসের বাইরের প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখলে তারা কি কি করতো তা আবার আড্ডায় রসিয়ে রসিয়ে বলতো। আমি অবাক হতাম! কখনো যদি প্রতিবাদ করে বলতাম, "এইগুলা তো ঠিক না, ওরা প্রেম করুক না যা করুক তাতে তোমাদের কি সমস্যা?" 

জবাব আসতো ওরা এসব করে নাকি ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট করছে! আমি কখনোই বুঝতে পারিনি প্রেম ভালোবাসা কিভাবে একটা পরিবেশ নষ্ট করে? 

চুমু দেয়ার মতো ব্যাপারও এতো অশ্লীল গণ্য করা হবে? ঠিক আছে, পরিবারের সামনে এটা দিতে লজ্জা লাগা উচিত, লজ্জা লাগেও কিন্তু লজ্জা এক জিনিস আর অশ্লীলতা আরেক ব্যাপার৷ 

একটা উত্তাল বয়সে সেটেল হওয়ার আগে বিয়েও করতে দিবেন না আবার প্রেমও করতে দিবেন না তাতে কি হয় জানেন? সেক্সচুয়াল ফ্রাস্টেশন।

তাদের জিজ্ঞাসা কর‍তাম এইগুলা করে কি লাভ? তারা বলতো মজা লাগে। স্রেফ মজার জন্য তারা কি কি করতে পারে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

কাল যেটা হয়েছে এটা এমসি কলেজে রেগুলার হয়ে আসছে৷ প্রেমিক প্রেমিকা একসাথে থাকলে হেস্তনেস্ত করা,চড় থাপ্পড় দিয়ে মানিব্যাগ মোবাইল কেড়ে নেয়া, মেয়ের বুকে হাত দেয়া, এমনকি সুযোগ বুঝে মেয়েকে রেপ করা... কি হয় না?

কালকের ঘটনা কেন ফ্লাস হইছে জানেন? কারণ তারা স্বামী স্ত্রী ছিলো। আজ যদি তারা প্রেমিক প্রেমিকা হতো তাহলে কিছুই হতো না। কেউ জানতোও না।
২০১৮ সালে সেইম একটা ঘটনা ঘটেছে ভিসি বাংলো রোডে(কারা করেছে নামসহ বলে দিতে পারবো), ছেলে মেয়েকে আপত্তিকর অবস্থায় পেয়েছে এমন অযুহাতে মেয়েকে রেপ করা হয়, মোবাইল মানিব্যাগ রেখে দেয়া হয়।  

পরবর্তীতে ছেলেটা ক্যাম্পাসেরই হওয়ায় জনৈক নেতা তাদের ধমক দিয়ে মোবাইল মানিব্যাগ ফেরত দিতে বলে। তারা বলে , "ভাই টাকা খরচ করে ফেলছি",তখন নেতা বলে," খরচ করে ফেললে কি আর করা; অন্তত ওর মানিব্যাগ তো দিবি!" 

বুঝেন এই হলো অবস্থা। ধর্ষণ যে হলো এটা নিয়ে কোন কথাই হয়নি। অবৈধ প্রেম করলে এরকম হবে এটাই নিয়তি আবার চ্যলারা এরকম একটু আধটু সুবিধা নিবে এটাও নিয়ম।  
এতো কিছু লেখার কারণ হলো শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা এসব কিছুই জানে এবং অনেকে নিজেরাও সরাসরি যুক্ত। তোমরা যারা আজ ধর্ষকের ফাসি চাই, হেন চাই তেন চাই করছো তোমরা তো সব জানো তারপরেও এসব লিখতে তোমাদের একটু বাধে না? এতোটা ভালোমানুষ কিভাবে সাজো তোমরা?

আর হ্যা এটা শুধু এমসি কলেজের চিত্র না। সারা বাংলাদেশের সব ক্যাম্পাসের চিত্র। কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না আমার ক্যাম্পাস মেয়েদের জন্য নিরাপদ। কেননা আমরা সবাই জানি, সুযোগের অভাবে আমরা সবাই সৎ... " 
এটা হচ্ছে ছেলেটার লেখা। সে হয়ত সেভাবে গুছিয়ে লিখতে পারেনি। তাছাড়া তার সব মতামতের সাথে আমি একমত নই।  

আমি বরং ছোট করে আমার মতামত দেই। ছয়-সাত জন ধর্ষকের ছবি এখন পুরো ফেসবুক জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা কি ছেলে গুলোর ছবি ভালো করে খেয়াল করেছেন? 
একজন ছাড়া বাদ বাকী সবার কি চমৎকার ফ্যাশন কিংবা সুন্নতি দাঁড়িসহ ছবি। দেখলে মনে হবে- ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না।  

রক্তে-মাংসের এই ছেলে গুলো যে কতোটা হায়েনা এবং অমানুষ হতে পারে, সেটা তো এর মাঝেই জেনে গিয়েছেন। স্বামী'র সামনে টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।  
তো, এইসব ছেলে-পেলে এমন ধর্ষক হয়ে উঠছে কেন? 
ভাইরে, এটাই আমাদের সংস্কৃতি।  

আপনি ছেলেদের যে কোন আড্ডায় যান; দেখবেন এইসব নিয়েই এরা কথা বলছে। ঠিক যেমনটা উপরের লেখায় ছেলেটা বর্ণনা করেছে। আপনি প্রতিবাদ করতে যান। পাশে থাকা একেকটা বীরপুরুষ কি বলবে জানেন? 

- তোর সমস্যা কি? তুই কি লাফ লেডিস নাকি? এরপর কি হবে জানেন? আপনার বন্ধু-বান্ধবের কাছে যাতে আপনি হাফ লেডিস না হয়ে যান; আপনিও এমন আচরণ শুরু করবেন! 

হ্যাঁ, ঠিক'ই পড়ছেন। কারন আমাদের সমাজে পুরুষদের চর্চা'ই এমন। এরা পুরুষ হিসেবে জন্মে নিজেদের একেক জন "হিরো" মনে করে! 

এই যে, কেউ প্রতিবাদ করলে "হাফ লেডিস" টাইপ উপাধি দেয়া হয়; এখন প্রশ্ন হচ্ছে 
-লেডিস হলে সমস্যা কোথায়? 

নারী হয়ে জন্মানো কি পাপ নাকি? অথচ আমাদের সমাজে আমরা বিষয়টাকে গালির পর্যায়ে নিয়ে এসছি।  

ও, আরেকটা কথা। মেয়েটাকে তার স্বামীর কাছ থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে এতো গুলো ছেলে ধর্ষণ করার পর যখন পুলিশ এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়েছে; তখন কিন্তু পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে কলেজের অধ্যক্ষের অনুমতি নিতে হয়েছে।  এটাই নিয়ম।  


আরও পড়ুন: সাত মাস, কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না, বাইরে যাচ্ছি না


এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে- দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একটা ক্যাম্পাসে কী বিনা অনুমতি'তে এইসব হয়ে যাচ্ছে? এটা কি কারো পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব? 

অবশ্য প্রশাসনে বসে থাকা সবাই তো এইসব ধর্ষকদের মতো'ই বীরপুরুষ। নিজদের আড্ডায়, চায়ের টেবিলে; পাড়ার মোড়ে স্রেফ দাঁড়িয়ে থেকে এইসব পুরুষরা চোখ দিয়ে যেভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া নারীদের ধর্ষণ করে; সেই দৃশ্য দেশের যে কোন রাস্তার মোড়ে প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায়।  

এটাই আমাদের সমাজ। এই সমাজে ধর্ষণ করে বন্ধুদের আড্ডায় এরা "হিরো" হয়। বিশ্বাস করুন, এটাই বাস্তবতা। কিংবা ধর্ষণ যদি নাও করতে পারে, এই ধরনের নানান সব বাজে কথা বলে কিংবা আড্ডা দিয়েও এরা বন্ধুদের আড্ডায় "হিরো" হয়।  
ধর্ষণের মানসিকতা এভাবেই তৈরি হয়। কারন স্রেফ জন্মসূত্রে পাওয়া "পুরুষ" উপাধির কারনে জন্মের পর থেকে পরিবার, স্কুল, কলেজ এবং সমাজ আপনাকে শেখায়- তুমি পুরুষ। তাই তুমি "হিরো!"

আমিনুল ইসলাম : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অস্ট্রিয়া । (ফেইসবুক থেকে )

news24bd.tv নাজিম