‘গা শিউরে ওঠার মতো’ বর্ণনা দিলেন গণধর্ষণের শিকার তরুণীর স্বামী

অনলাইন ডেস্ক

ধর্ষণের বিভীষিকাময় ঘটনা যদি ঘটে কারও বাস্তব জীবনে, তবে থমকে যায় সময়-অন্ধকার নেমে আসে জীবন অধ্যায়ের প্রতিটি পাতাজুড়ে। এমন অবস্থাই এখন সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার নববধূ ও তার স্বামীর। আজ বুধবার নির্যাতিতার স্বামী খুলে বললেন সেই ভয়াল সন্ধ্যার নির্মম গল্প।

নববধূর স্বামী জানান, গত শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার আগে স্ত্রীসহ প্রাইভেটকারযোগে হযরত শাহপরাণ (র.) এর মাজার জিয়ারতে যান তিনি।

জিয়ারত শেষে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন মাজার থেকে। এসময় স্বামীকে স্ত্রী বলেন, ‘আমার একজন ছেলেবন্ধু দেখা করার জন্য কল করেছে। তার সঙ্গে এমসি কলেজের গেটে দেখা করবো। ’ এতে সম্মতি জানান স্বামী।
তবে সেই বন্ধুর দেখা করার সময় স্বামী সামনে ছিলেন না বলে তিনি জানান।

আর পড়ুন: ‘ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা’, পুলিশ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ

নববধূর স্বামী জানান, স্ত্রীর সেই বন্ধুর নাম আইনুল। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে এবং রিমান্ডে নেয়।

মামলার বাদি বলেন, এমসি কলেজের মূল ফটকের সামনে পাকা রাস্তার উপর গাড়ি রেখে স্ত্রীকে তিনি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিয়ে পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে সিগারেট কেনেন। পরে গাড়িতে এসে ওঠার সময় ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর তাকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘এই দাঁড়া, তোর সঙ্গে এই মেয়ে কে?’ এ সময় তিনি বলেন- আমার স্ত্রী। এ সময় এগিয়ে আসে সাইফুর-অর্জুনের সহযোগী তারেকুল ইসলাম তারেক, শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি। তখন তারা নববধূর স্বামীকে চড়-থাপ্পড় মারে। তখন তার স্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে এর প্রতিবাদ করলে আসামিরা স্বামী-স্ত্রীকে ধমক দিয়ে জোরপূর্বক গাড়িতে ওঠিয়ে নেয়। এসময় তারেকুল ইসলাম তারেক ড্রাইভিং সিটে বসে ও স্ত্রীকে সামনের সিটে এবং স্বামীকে পিছনের সিটে ওঠিয়ে সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর তার সাথে পিছনের সিটে ওঠে বসে।

আরও পড়ুন: এবার সাভারে গণধর্ষণের আরেক লোমহর্ষক ঘটনা

পরে তরিকুল ইসলাম গাড়ি চালিয়ে এমসি কলেজ হোস্টেলের ফটকের সমুখস্থ ছোট্ট ব্রিজে এসে গাড়ি দাঁড় করায় এবং নববধূর স্বামীর কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। তখন তিনি ২ হাজার টাকা দিয়ে তার কাছে আর টাকা নাই বলে জানান। কিন্তু ধর্ষকরা স্বামী-স্ত্রীকে ছেড়ে না দিয়ে গাড়িটি ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণের ৭ নং ব্লকের ৫ তলা নতুন বিল্ডিং এর দক্ষিণপূর্ব কোণে খালি জায়গায় নিয়ে যায়। অন্যরা তখন মোটরসাইকেলযোগে পিছনে পিছনে ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

এসময় তরিকুল, মাহবুবুর রহমান রনি ও অর্জুন লস্কর নববধূর কানের দুল এবং সোনার চেইন কেড়ে নেয়। এসময় চিৎকার করলে আসামিরা নববধূর মুখ চেপে ধরে।

আরও পড়ুন: ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে যুবলীগ নেতা ধরা

পরে স্ত্রীকে গাড়িতে রেখে সাইফুর, তারেক রনি ও অর্জুন স্বামীকে ৭ নং ব্লকের পশ্চিমপাশে নিয়ে যায়। এসময় নববধূর স্বামীকে কথা বলায় ব্যস্ত রেখে প্রথমে সাইফুর রহমান এবং পরবর্তীতে একে একে তারেকুল ইসলাম, মাহমুবু রহমান রনি ও অর্জুন লস্কর প্রাইভেটকারের ভিতরেই নববধূকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তখন স্ত্রীর চিৎকার শুনে স্ত্রীকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে গেলে আসামিরা তাকে মারধর করে এবং আটকে রাখে।

নববধূকে ধর্ষকরা নির্যাতন করার সময় ৫ তলা বিল্ডিং-এর দ্বিতীয় তলার বারান্দায় একজন ছেলে আসলে তাকে ধমক দেয় এবং চলে যেতে বলে ধর্ষকরা।

আরও পড়ুন: এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ; রনি-রাজন-আইনুল ৫ দিনের রিমান্ডে

নববধূর স্বামী বলেন, প্রায় আধা ঘণ্টা পর তার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি থেকে নেমে স্বামীর নিকট আসলে আসামিরা তাদের প্রাইভেটকার আটকে রেখে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে বলে এবং ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে বললে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে কলেজে হোস্টেলের গেটে যান এবং একটি সিএনজি অটোরিকশা ডেকে প্রথমে শিবগঞ্জ পয়েন্টে আসেন এবং পরে পুলিশকে ঘটনা জানাতে টিলাগড় পয়েন্টের দিকে রওয়ানা দেন। এসময় নিজের কাছে কোনো টাকা না থাকায় নবধূর স্বামী অটোরিকশা চালকের কাছে একশ টাকা ধার চান। তবে তাদের অবস্থা দেখে অটোরিকশা চালক তাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করে। ওই সময় সিএনজি অটোরিকশাতে বসেই তিনি সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের অফিসিয়াল ফোন নাম্বারে কল দেন এবং ঘটনার বিবরণ বলেন। এ কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ কমিশনারের নির্দেশক্রমে শাহপরাণ থানার সহকারী কমিশনার ধর্ষিতার স্বামীকে ফোন দেন এবং ঘটনাস্থল ও ঘটনার বিবরণ শুনে পুলিশ প্রেরণ করেন।

আরও পড়ুন: যতদিন নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারের লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হবে

এদিকে, নববধূর স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজের পেছনের গেটের (গোপাল টিলাস্থ) একটি রেস্টুরেন্ট বসে পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকেন। এসময় এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিহিত গুহ চৌধুরী বাবলা। তখন ওই নির্যাতিতা নববধূ কাঁদছেন দেখে তিনি সেখানে দাঁড়ান এবং ঘটনার বিস্তারিত শুনেন। তখন বাবলা নববধূর স্বামীকে নিয়ে ছাত্রাবাসের গেইটে যান। এসময় পুলিশও চলে আসে। এসময় উপস্থিত ছিলেন শাহপরাণ থানার সহকারী কমিশনার (এসি) মাইনুল আফসার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম।

আরও পড়ুন: এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ: আসামি রাজন গ্রেপ্তার

তখন পুলিশ টিম ভেতরে ঢোকার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষা করে। তবে শাহপরাণ থানাপুলিশের এস.আই সুহেলকে নিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বাবলা ভেতরে ঢুকেন এবং কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলেন, অভিযুক্তরা ভেতরেই আছে।

পরে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে পুলিশ ছাত্রাবাসের ভেতরে ঢুকে এবং বাদি এসময় ৭ নং ব্লকে তার  গাড়িটি পুলিশকে দেখান এবং দ্বিতীয় তলার ছেলেটি ঘটনার সময় বেরিয়ে এসেছিলো তাকে শনাক্ত করেন। ছেলেটি তার নাম হৃদয় পারভেজ বলে জানায়।

আরও পড়ুন: আদালতে সেই রাতে গণধর্ষণের রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন নববধূ

তখন হৃদয় পারভেজ জানায়, সে যখন বারান্দায় এসেছিলো তখন তার রুমেমেট (৩ নং আসামি) শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রণি তাকে চলে যেতে বলে।

এসময় পারভেজসহ হোস্টেলের অন্য ছাত্ররা মোবাইলে রনি এবং অন্য আসামিদের ছবি দেখায়। এসময় ছাত্রলীগের ৬ জনকে  শনাক্ত করা হয় এবং তাদের নাম ঠিকানা জানতে পারে পুলিশ। অন্য আরও ২/৩ জন আসামির পরিচয় জানতে পারেননি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাদি গড়ি ও ওদের ব্যবহৃত ১টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করে।

আরও পড়ুন: সিলেটে বেপরোয়া ছাত্রলীগ, একের পর এক তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মানুষ

পরে রাত ১২টার দিকে পুলিশের সহায়তায় তার স্ত্রীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে এজাহার দায়ের করেন।

চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণ মামলায় এজাহারনামীয় ছয় আসামিসহ সিলেট রেঞ্জ পুলিশ ও র‌্যাব-৯ এর হাতে গ্রেফতার আটজনের মধ্যে সাতজনকে পাঁচদিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

গ্রেফতারকৃত ও রিমান্ডে নেয়া আসামিরা হচ্ছে- সাইফুর রহমান, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান রনি, রাজন, আইনুল ও মাহফুজুর রহমান মাছুম।

আরও পড়ুন: সিলেটে গণধর্ষণ: মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি ৫ দিনের রিমান্ডে

সূত্র- বিডি প্রতিদিন

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর