অনন্ত জলিল চাপে পড়ে ক্ষমা চেয়েছেন, অন্তর থেকে নয়

অনন্ত জলিল চাপে পড়ে ক্ষমা চেয়েছেন, অন্তর থেকে নয়

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা গত দুদিন ধরে ধর্ষণের প্রতিবাদ করছে। ধর্ষণটা সারা বছর চলে। প্রতিবাদটা কিন্তু বরাবরই সিজনাল।

কোনও এক অনন্ত জলিল নাকি ধর্ষণের জন্য ধর্ষককে নয়, মেয়েদের দোষ দিয়েছেন।

এ কি নতুন কিছু? ছেলে-মেয়েরা অবশ্য অনন্ত জলিলের ওপর ক্ষেপেছে। অনন্ত জলিলের মতটাই, মানি বা না-মানি, প্রায় সকলেরই মত। অনন্ত জলিল চাপে পড়ে ক্ষমা চেয়েছেন। ওই ক্ষমা তিনি অন্তর থেকে চাননি।
তাঁর স্বতস্ফূর্ত প্রথম বক্তব্যই তাঁর অন্তরের কথা, যা তিনি বিশ্বাস করেন। ক্ষমা চাওয়ার পরও বিশ্বাস করেন।

স্রোতের অনুকূলেই যেতে হয় বলে গিয়েছেন। মোশারফ করিম নামে এক অভিনেতাকে ঠিক এর উল্টো কথা বলার অপরাধে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।

উনি বলেছিলেন, পোশাকের কারণে ধর্ষণ ঘটে না। ওই মন্তব্য করার পর মোশারফ করিমকেও চাপের মুখে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। হ্যাঁ , সত্য বলার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। সংশোধন করে মোশারফ করিম যা বলেছিলেন তা হলো পোশাকের কারণেই ধর্ষণ ঘটে। ঘটনাটি কবে ঘটেছিল? দু বছর/ তিন বছর আগে? এই ক'দিনে দেশ কি এত ভালো হয়ে গেল যে অনন্ত জলিলকে ক্ষমা চাইতে হয় মেয়েদের পোশাকের কারণে ধর্ষণ ঘটে বলার জন্য? না, দেশ আগের মতো নষ্টই আছে, আগের মতোই নারীবিদ্বেষী। শুধু কিছু লোকের প্রতিবাদের বাই উঠেছে বলে মনে হচ্ছে দেশ বদলে গেছে। দেশের কিছু বদলায়নি, কাল থেকেই আবার পুরোদমে ধর্ষণ শুরু হবে।

এখনও হচ্ছে ধর্ষণ, আমরা খবর পাচ্ছি না। ঘরে ঘরে স্বামীরা কি স্ত্রীদের আজ ধর্ষণ করছেন না? নিশ্চয়ই করছে্ন। ধর্ষণ করার অধিকার, স্বামীরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের আছে। সব বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, মন্ত্রী, মহামন্ত্রী, সমাজপতি প্রমুখও বিশ্বাস করেন আছে। আছে মনে করেন বলেই তো জোর জবরদস্তি স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা আইনের চোখে আজও ধর্ষণ নয়।  

যারা ধর্ষককে ফাঁসি দেওয়া, ধর্ষকের ধর্ষদণ্ড কর্তন করা, ধর্ষককে ক্রশফায়ারে মেরে ফেলা ইত্যাদির জন্য চিৎকার করছে, তাদের অধিকাংশই খুব গোপনে বিশ্বাস করে ধর্ষণের কারণ মেয়েরাই। মেয়েরা যদি সংযত হয়ে চলাফেরা করতো, যদি ঠিকঠাক পোশাক পরতো, রাতে একা না বেরোতো, তাহলে ধর্ষণ হতো না। তাদের কেউ কেউ যে সুযোগ পেলে ধর্ষণ করবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

বাংলাদেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবীই বিশ্বাস করেন ধর্ষণে। বিশ্বাস করেন মেয়েদের না মানে হ্যাঁ, বিশ্বাস করেন একটু জোর জবরদস্তি না করলে যৌন সঙ্গমে আনন্দ নেই। সাধারণ মানুষ ব্যতিক্রম হলে কতটাই বা হবে।

তবু হোক প্রতিবাদ। এইসব প্রতিবাদের ফলে, মুশকিলটা হলো, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড জারি করে সরকার তড়িঘড়ি দায়মুক্ত হবে। ধর্ষণের মূল কারণগুলোর চর্চা চলতেই থাকবে সমাজে। তাতে সরকারের কিচ্ছু যাবে আসবে না।

তসলিমা নাসরিন, লেখক।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর