বিদ্যমান আইনকে দোষারোপ করা উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর নামান্তর
ধর্ষণ মামলার বিচারে ভিকটিমের চরিত্রহনন

বিদ্যমান আইনকে দোষারোপ করা উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর নামান্তর

সোহেল রানা

যৌন নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের অভিযোগ আনা মামলার বিচার চলার সময় আদালতে ভিকটিম অর্থাৎ ধর্ষিতাকে আসামীপক্ষের আইনজীবী মাঝে মাঝে এমন কিছু প্রশ্ন করেন যা তাঁর জন্য অপমানজনক ও কষ্টদায়ক তো বটেই, চরিত্রহানীকরও বটে। এটা ধর্ষিতার মনে ধর্ষণের যন্ত্রণাটাকে বার বার মনে করিয়ে দেয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোনো নারী যখন যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনায় মামলার আশ্রয় নেন তখন বিচারকার্য শুরু হওয়ার পর আদালতে নয়, এরও আগে থানা ও হাসপাতালেও তাকে নানা অপমানজনক আচরণ, মন্তব্য ও বাঁকা চাহনি হজম করে আসতে হয়। এসব কারণেই এ কথাটি প্রচলিত হয়ে আছে যে, ধর্ষণের বিচার চাওয়া পুনরায় ধর্ষিত হওয়ার নামান্তর।

এমন পরিস্থিতি মানবিক বোধসম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তির জন্যই পরিতাপের বিষয় এবং এ কারণেই বর্তমানে অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠি ও প্রতিষ্ঠান বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ও প্রতিবাদের পাশাপাশি প্রতিকার হিসাবে অনেক সুপারিশও প্রকাশ করছেন। প্রবণতাটি ইতিবাচক তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আশংকাও রয়েছে। কারণ, ধর্ষণ মামলার বিচার চলার সময় ভিকটিমকে যে আদালতে চরিত্রহননের শিকার হতে হয় সেটির প্রতিরোধ হিসাবে অনেকেই প্রচলিত আইনের বিদ্যমান একটি বিধানকে (ধারা ১৫৫, দ্য এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২) দায়ী করে সেটি বিলোপের প্রস্তাব করছেন। এমন প্রস্তাবকে ‘আশংকাজনক’ বলার প্রধান কারণ হচ্ছে, ভিকটিমের ওপর অপমানজনক মন্তব্য করার জন্য সাক্ষ্য আইনের উক্ত বিধানটি মোটেও দায়ী নয় এবং সেটি বিলোপের প্রস্তাব বা ইচ্ছা এমনসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এসেছে যারা আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের বিষয়ে সরকারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন!  

ধর্ষণের পূর্বশর্ত বা প্রধান উপাদান হলো যৌন সঙ্গম অর্থাৎ নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন।

‘যৌন সঙ্গম’ একটি সাধারণ বা জৈবিক ক্রিয়া, আর ‘ধর্ষণ’ হচ্ছে সেটির

একটি আইনি বা অপরাধমূলক রূপ। একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে সংঘটিত যৌন সঙ্গম বা শারীরিক মিলন ক্ষেত্রবিশেষে যখন বেআইনি হয়ে যায় তখনই বলা হয় যে, ঐ পুরুষটি ঐ নারীকে ধর্ষণ করেছেন। ক্ষেত্রগুলির উদাহরণ হচ্ছে, যখন তাদের মধ্যকার শারীরিক মিলনটি নারীর অনিচ্ছায় বা অসম্মতিতে হয় কিংবা সম্মতিটি ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে আদায় করা হয়ে থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি (ধর্ষণের পরিপূর্ণ সংজ্ঞা বুঝতে হলে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারার সাথে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারা মিলিয়ে পড়তে হবে)। অর্থাৎ, সব ধর্ষণই যৌন মিলন, কিন্তু সব যৌন মিলন ধর্ষণ নয়।

দেওয়ানি বা ফৌজদারি, উভয় প্রকৃতির মামলায় সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা খর্ব করা বিপক্ষের জন্য অন্যতম একটি কৌশল, এবং এটি আইনসম্মত ও প্রয়োজনীয়ও বটে। কারণ, এমন সুযোগ না থাকলে সাক্ষীর অসত্য বক্তব্য বিচারকের বিশ্বাস হয়ে যেতে পারে এবং ফলশ্রুতিতে মিথ্যা অভিযোগে কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়ে যেতে কিংবা বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। দেওয়ানি প্রকৃতির মামলায় ততটা না হলেও ফৌজদারি মামলায় বিচারকের সিদ্ধান্ত বা অনুমান অনেকাংশেই ‘মৌখিক সাক্ষ্য’র (সাক্ষী হিসাবে কোনো ব্যক্তির মুখের কথা) ওপর নির্ভরশীল। ফলে ফৌজদারি মামলায়ই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ও প্রয়োজন হয় সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে খর্ব করানোর। সাক্ষ্য আইনটির ১৫৫ ধারায় কোনো সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে খর্ব করানোর ৪টি কৌশল বা সুযোগ দেয়া হয়েছে যার শেষোক্তটির সারমর্ম হলো, ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির চেষ্টার মামলায় অভিযোগকারীনী নারী দুশ্চরিত্রা মর্মে দেখানো যাবে (...when a man is prosecuted for rape or an attempt to ravish, it may be shown that the prosecutrix was of generally immoral character).

অর্থাৎ, ধর্ষণ মামলার বিচারে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার অবাধ লাইসেন্স সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারাই আসামীপক্ষকে দিয়েছে মর্মে যে অভিযোগ কেউ কেউ করে থাকেন তা মোটেও গ্রহণযোগ্য বা বস্তুনিষ্ট নয়। কারণ, উপরোল্লিখিত শব্দগুচ্ছের মধ্যকার prosecutrix (victim নয়) ও I may be shown শব্দগুচ্ছই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, বাস্তবে সত্য না হলে অর্থাৎ দেখিয়ে দেয়ার মতো প্রমাণ না থাকলে অভিযোগকারীনীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই এবং এমন প্রশ্ন আবশ্যিকভাবে শুধুমাত্র ‘ভিকটিম’ নয় বরং ‘সাক্ষী’র ওপর প্রয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে (মামলার বাদী বা সাক্ষী হওয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগকারীনী ও ভিকটিম ভিন্ন ব্যক্তিও হতে পারেন)।  

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ঐ বিধানটি কাজে লাগিয়েই আদালতে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে অবাধে যাচ্ছেতাই প্রশ্ন করা যাচ্ছে, তাহলেও এর জন্য ঐ আইনকে দায়ী করার সুযোগ নেই; দায়ী হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট আদালত বা ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং আসামীপক্ষের আইনজীবীগণ। কারণ, সাক্ষ্য আইনটিতে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরিকারী ১৫৫ ধারা যেমন আছে, তেমনি বিচারকার্য চলার সময় অপ্রাসঙ্গিক, অসঙ্গত, অবমাননাকর ও অপ্রয়োজনীয় ধরনের প্রশ্ন যাতে কেউ না করেন বা করলেও বিচারক যাতে থামিয়ে দেন সেরুপ বিধানযুক্ত ১৪৮,১৪৯,১৫০,১৫১,১৫২ ইত্যাদি ক্ষমতাশালী ধারাগুলিও কিন্তু রয়েছে। কোনোপক্ষ যদি আইনের কোনো বিশেষ বিধানকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে অন্যকোনো বিধান দিয়ে সেটি থামানোর কৌশলও বিচারকদের জানা থাকতে হয়।  

এর পরেও কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ঐ বিধানটি যেহেতু বিতর্ক তৈরি করছেই, সেহেতু সেটি বাতিল করে দিলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আছে এবং সেটি হবে মাথা ব্যাথার জন্য খোদ মাথাটিই কেটে ফেলা কিংবা সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে বলে অস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া। অস্ত্রের উৎপাদন বন্ধ করে দিলে সন্ত্রাসীদের সমস্যা হবে সামান্য, কিন্তু আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী চলবে কীভাবে? একজন ব্যক্তি যখন ফৌজদারি মামলার আসামী বা অভিযুক্ত হন, তখন তিনি নিজেকে নির্দোষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগকে অসত্য প্রমাণের জন্য উপযোগী যে কোনো ডিফেন্স গ্রহণ করতে পারেন এবং এটা তাঁর আইনগত ও মানবিক অধিকার।


আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতরা কে কেমন?


কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে যখন ধর্ষণের অভিযোগে বিচার চলে, তখন তিনি ডিফেন্স হিসাবে প্রধানত ৩টি অবস্থা বা ঘটনার অস্তিত্ব দাবি করতে পারেন। এক, ভিকটিম নারীটি আদৌ যৌন মিলনের শিকার হননি; দুই, তিনি যৌন মিলনের শিকার হয়ে থাকলেও সেটি অভিযুক্ত পুরুষটির সাথে হয়নি; তিন, তিনি যৌন মিলনের শিকার হয়েছেন এবং তা অভিযুক্ত পুরুষটিরই সাথে, কিন্তু মিলনকার্যটি এমনভাবে হয়নি যাতে সেটিকে ধর্ষণ বলা যায় (যেমন, ঘটনাটি নারীটির ইচ্ছায় ও সম্মতিতে হয়েছে এবং সম্মতিটি ছিল অবাধ)। আইন বা ধর্মের দৃষ্টিতে যেমন-ই হোক, পতিতাবৃত্তি যে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদি এমন হয় যে, একজন পুরুষ একজন পতিতার সাথে যৌনসঙ্গম করলো, কিন্তু পরে কোনো কারণে মহিলাটি ঐ পুরুষটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের (জোরপূর্বক সঙ্গম) অভিযোগ আনলো। এ ক্ষেত্রে ঐ পুরুষের কাজটি ধর্ষণ না হওয়া সত্তেও তাকে যেহেতু অভিযুক্ত হতে হয়েছে সেহেতু অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তাকে যখন ডিফেন্স নিতে হবে তখন ঐ ধারার বিধানটিই কিন্তু তার জন্য রক্ষাকবচ হবে।


আরও পড়ুন: অনন্ত জলিল সমাজের নোংরা ময়লা


অভিযুক্ত হিসাবে পুরুষটি যখন দেখাতে পারবেন যে, অভিযোগকারীনী একজন পেশাগত পতিতা, তাহলে সঙ্গমের জন্য মহিলার ওপর জোর খাটানো হয়েছে মর্মে  দাবি আদালতের কাছে দুর্বল বা হাস্যকর হয়ে যাবে। অন্যদিকে, ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত যদি ডিফেন্স হিসাবে এরুপ অবস্থান নেন যে, ভিকটিম নারীটি আদৌ যৌন মিলনের শিকার হননি বা হলেও তা অভিযুক্ত পুরুষটির সাথে নয়, তাহলে ভিকটিমটি ব্যক্তিগতভাবে পতিতা কি না তা মুখে আনার সুযোগ বা প্রয়োজনই কিন্তু আসামীপক্ষের থাকবে না এবং আসামীপক্ষ তা করতে গেলে বিচারকের ক্ষমতা ও দায়িত্ব রয়েছে তা থামিয়ে দেয়ার। এছাড়াও, অভিযুক্তের গৃহিত ডিফেন্স অনুযায়ী যদি এরুপ মনে হয় যে, সাক্ষ্যগ্রহণকালে ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ সঙ্গতভাবেই আসামীপক্ষ পেতে পারে, তাহলে বিচারকের উচিৎ হবে রুদ্ধদ্বার কক্ষে  বিচারকার্য সম্পন্ন করা এবং এরুপ করার অবাধ ক্ষমতা কিন্তু বিচারকের রয়েছে।


আরও পড়ুন: সাজা নাকি সাজা পাওয়ার ভয়, কোনটি দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত


তাই, সকলকে এটা মানতে ও উপলব্ধি করতে হবে যে, ধর্ষণ মামলা বিচারের সময় ভিকটিমকে তার চরিত্র নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন করার যে চর্চা কোর্ট-কাচারীতে প্রচলিত আছে সেটির জন্য সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারাকে কোনোভাবেই দায়ী করার সুযোগ নেই। প্রতিরোধ বা প্রতিকার হিসাবে বিধানটি তুলে দিলে তা হবে আত্মঘাতি ও হিতে বিপরীত, অর্থাৎ অন্যায় পন্থায় মানুষকে হয়রানির মারাত্মক সুযোগ তৈরি হবে। এমনিতেই এটা সকলের জানা যে, বাংলাদেশের আদালতগুলিতে নারী নির্যাতনের যতগুলো মামলা আছে তার অধিকাংশই মিথ্যা বা হয়রানিমূলক। ভিকটিমের চরিত্র নিয়ে অহেতুক ও অবমাননাকর প্রশ্ন করার জন্য প্রথমত দায়ী হচ্ছে আইনজীবীগণের পেশাগত অদক্ষতা বা অজ্ঞতা এবং রুচিহীন মানসিকতা; আর চূড়ান্তভাবে দায়ী হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিচারকগণের উন্নাষিক বা নির্লিপ্ত আচরণ কিংবা অ্যাকটিভিজমের অভাব। উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর পরিণতি যেমন সুখকর হয় না, তেমনি নাচতে না-জানার  ত্রুটি লুকানোর জন্য উঠোনকে দোষারুপ করাও হাসির জন্ম দেয়!

লেখক: সোহেল রানা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা
sranajo@gmail.com