ভারতবর্ষের হাজার বছরের শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থার যাবতীয় অর্জন-নিদর্শনকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ইংরেজি ভাষা আর বিচারব্যবস্থাকে আমাদের অন্তরাত্মায় সিলমোহর মেরে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য লর্ড ম্যাকলে'র নিন্দামন্দের শেষ নেই। আর এদেশে কেরানী উৎপাদনের অনন্ত ফ্যাক্টরি স্থাপনের অভিলাসী অমিয়বচন তো আমাদের প্রবচনে ঠাঁই নিয়েছে।
এহেন "কুখ্যাত" ম্যাকলে মশাই যখন দণ্ডবিধি'র (Penal Code) খসড়া প্রস্তুত করছিলেন, তখন একপর্যায়ে তিন (০৩) টা অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়। অপরাধ ০৩ টি হলো-
ডাকাতি ধর্ষণ ও অঙ্গচ্ছেদ (mutilation)।
ম্যাকলে'র কমিটি সারাদেশেই ব্যাপক পর্যবেক্ষণ করেছে ও মতামত নিয়েছে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি বা পুলিশ আইন নিয়ে। বেশিরভাগ ভারতবাসী এই ০৩ অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু ম্যাকলে অনড়! তার সাফ কথা- সমস্ত ভারতবাসী মিলেও যদি এই ০৩ অপরাধে ফাঁসি চান, তবুও তিনি দেবেন না!
তার যুক্তি- এই ০৩ অপরাধের ধরন কী? এসব ক্ষেত্রে ভিক্টিম থাকে চূড়ান্ত রকমে অসহায়। কেবল আসামির দয়া'র উপর ভিক্টিমের জীবন-মৃত্যু নির্ভর করে।
অপরাধীকেও দয়া দেখানোর সুযোগটা দিতে হবে! সেও মানুষ। তার নেতিবাচক আবেগের জন্য যেমন সাজা দিতে হবে, তেমনি চরমতম মুহূর্তেও আবেগের ইতিবাচকতার জন্য তাকে thank_you জানাতে হবে- প্রায় ২০০ বছর আগেও এই ছিলো চিন্তা।
ম্যাকলে, স্টিফেন্স বা অন্য ইংরেজদের প্রণীত নানান ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনের ড্রাফটিং এর চমৎকারিত্ব নিয়ে অনেক একাডেমিক'কেই প্রশংসায় গদগদ হতে দেখা যায়। যারা এসব নিয়ে সরাসরি কাজ করেন যেমন- জাজ, উকিলদের মধ্যে এই গদগদ ভাবটা কিছুটা কমই। কারণ, বিচারাঙ্গনে বিদ্যমান স্থবিরতার কারণও মূলতঃ এসব ব্রিটিশ আমলের আইন। আর তাদের প্রণীত প্রতিটি আইনের ছত্রেছত্রে আছে ব্রিটিশ শাসক, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, আমলা আর তাদের দেশীয় দোসর, উচ্ছিষ্টভোগী সুরক্ষা দেয়া আর দেশীয়দের হালুয়া টাইট করে দেয়ার নানান ফন্দিফিকির। গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়গণ এই বিষয়ে দারুণ বিশ্লেষণাত্মক কাজ করেছেন। তাসত্ত্বেও ম্যাকলে সাহেবের ভাবনার পদ্ধতি'কে আজো স্যালুট না দিয়ে উপায় নেই। কত দূর এগোলো মানুষ?
লেখক: মিল্লাত হোসেন, বিচারক