তরুণ সমাজের বিপদ: তসলিমা নাসরিন

তরুণ সমাজের বিপদ: তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিন

নিজের মুসলিম-দেশ ছেড়ে যে মুসলিমরা ইউরোপ আমেরিকায় বসে নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁদের অধিকাংশই বড় অবলীলায় সেই দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। বিষোদ্গার করতে তাঁদের দু’বার ভাবতে হয় না কারণ তাঁরা ভালো করেই  জানেন তাঁরা বাক-স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন একমাত্র ওসব দেশেই। বিষোদ্গারের জন্য তাঁদের কেউ জেলে ভরবে না, তাঁদের   মুণ্ডু কেটে কেউ রাস্তায় ফেলে রাখবে না। তাঁরা তখনই পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে সরব হন, যখনই মুসলিম সন্ত্রাসীরা ইসলামের নামে   সন্ত্রাস করে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় সভ্যতা, নিরীহ মানুষদের জবাই করে।

দেশগুলো সেক্যুলার (রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা), তারপরও তাঁরা দেশগুলোকে খ্রিস্টান দেশ বলবেন। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে পশ্চিমের দেশ আশ্রয় দিয়েছে, তারপরও বলবেন দেশগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, মুসলমানদের ঘৃণা করে, ইসলামকে ঘৃণা করে। মোদ্দা কথা, জিহাদি হত্যাযজ্ঞের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য একটা ‘যুক্তি’ বের করেন। এতে কাদের লাভ হয়? লাভ হয় জিহাদিদের।

তারা যে ঠিক কাজ করছে, এ ব্যাপারে তাদের ধারণা আরও পোক্ত হয়। অগুনতি মুসলিম তরুণও জিহাদি দলে যোগ দেওয়ার প্রেরণা পায়।

মুসলিমরা কেন সন্ত্রাস করছে, কেন দেশে দেশে অমুসলিম বা ইসলামে-অবিশ্বাসীদের হত্যা করছে ? যেহেতু কোনও এক কালে অমুসলিমরা মুসলিম-দেশগুলোকে উপনিবেশ করেছিল, যেহেতু ইসলামি খেলাফত ভেঙ্গে দিয়েছিল, যেহেতু ইজরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যেহেতু ইরাকে বা আফগানিস্তানে বোমা ফেলেছিল।  

সব অন্যায়ের ফল এখন ভোগ করতে হবে। আবার তাঁরা এও বলেন, জিহাদি নাকি পশ্চিমেরই সৃষ্টি, সন্ত্রাসী বাম দলগুলোও নাকি পশ্চিমের সৃষ্টি, এমনকি মুসলিম সমাজে যে মুক্তচিন্তক জন্ম নিচ্ছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলছেন, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার উদ্দেশে  ইসলামের সমালোচনা করছেন, তাঁরা নাকি মুক্তচিন্তক নন, তাঁরা নাকি যুক্তিবাদি নন, তাঁরা নাকি পশ্চিমা বিশ্বের ভাড়া করা লোক। এর মানে তাঁরা বিশ্বাস করেন খ্রিস্টান, ইহুদি , হিন্দু , বৌদ্ধ ধর্মীয় সমাজে মুক্তচিন্তক এবং যুক্তিবাদি জন্মাতে পারেন, কিন্তু মুসলিম সমাজে জন্মাতে পারেন না। তাঁরা, যা তাঁদের পছন্দ নয়, সব কিছুর ক্রীড়নক হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বকেই চিহ্নিত করেন। এতে বিরাট যে সুবিধে , তা হলো আত্মসমালোচনা করার প্রয়োজন হয় না।


আরও পড়ুন: নতুন আইন হলে ৮ মাস যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারবে না সাংবাদিকরা


তাঁরা মুসলিমদের ধর্ম নিরপেক্ষ, আধুনিক, গণতন্ত্রে-বাকস্বাধীনতায়-সমানাধিকারে বিশ্বাসী করতে চান না। তাঁরা চান এভাবেই মুসলিম সমাজ অন্ধকারে পড়ে থাকুক, আর তরুণ তরুণী  ধর্মান্ধ হতে থাকুক, আর সন্ত্রাস করতে থাকুক। তাঁদের কাজ মুসলিম দেশগুলোর যা কিছু খারাপ, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক দুরবস্থা, সব কিছুর জন্য তো বটেই, সন্ত্রাসীদের অপরাধের জন্যও, পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করা।


আরও পড়ুন: এস আই আকবরকে ধরা হয়নি বলে সে ধরা পড়েনি


ইহুদিরা যত অত্যাচারিত হয়েছে, তত আর কারা হয়েছে ইতিহাসে? ইহুদিরা কি কোনও এককালের নাৎসি ইউরোপে বোমা মেরে মেরে  প্রতিশোধ নিচ্ছে? জরথুস্ট্রপন্থী বা পার্সিরা আজও কিছু অবশিষ্ট আছে, তারা কি মুসলিমরা তাদের অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, বলে মুসলিমদের মুণ্ডু কাটছে?

মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বড় মুশকিল এই, যাঁদের কাজ মুসলিম সমাজকে ধর্মের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা, আইনকে ধর্মমুক্ত করা, নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, সেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা, শিক্ষিত সচেতন লোকেরাই মুসলিম সমাজের কোনও পরিবর্তন চান না, মুসলিমদের অন্ধকার থেকে বের করতে চান না, তাঁরাই ছলে কৌশলে জিহাদিদের ঘৃণ্য কার্যকলাপকে সমর্থন করেন।

লেখক: তসলিমা নাসরিন (ফেসবুক থেকে)

news24bd.tv আহমেদ