সালাম নিয়ে বেসামাল মন্তব্য

সালাম নিয়ে বেসামাল মন্তব্য

অধ্যাপক জাকির হোসেন

সালাম আরবী শব্দ। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, অভিবাদন, ইত্যাদি। সালামের উৎপত্তি কী? কোথা থেকে আসলো সালাম? মানুষের আবিষ্কার কী সালাম? উত্তর, অবশ্যই না।

‘সালাম’ আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম।

সালাম মানুষকে শিখিয়েছেন স্বয়ং আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ।

প্রমাণ চাচ্ছেন? মহান রব সর্ব প্রথম আদম (আঃ)-কে সালামের শিক্ষা দেন। আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ফেরেশতাদের সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেন।

তিনি সালাম দিলে ফেরেশতারাও সালামের উত্তর দেন।

 
হযরত আবু হুরাইরা (র.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন। তখন তাঁকে বললেন, ‘তুমি যাও এবং ঐ ফেরেস্তামন্ডলীর একটি দল বসে আছে, তাদের উপর সালাম পেশ কর।

আর ওরা তোমার সালামের কী জবাব দিচ্ছে তা মন দিয়ে শোনো। কেননা, ওটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তান-সন্ততির সালাম বিনিময়ের রীতি। সুতরাং তিনি (তাঁদের কাছে গিয়ে) বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’, তাঁরা উত্তরে বললেন, ‘আস-সালামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ’। তাঁরা ‘ওয়া রহমাতুল্লা বাক্যাটি বৃদ্ধি করেছেন’।

(সহীহ বোখারি, সহীহ মুসলিমের সূত্রে রিয়াযুস সালেহীন ৮৪৬)। তার মানে সালাম দিতে হবে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে। এর অন্যথা হলে তা ইসলাম সম্মত নয়।

আর স্লামালেকুম বা অন্য কোন কিছু বলা মহান রব কর্তৃক তাঁর বান্দাদেরকে শিখিয়ে দেয়া সালামের চরম বিচ্যুতি তথা আল্লাহ তা’আলার সাথে নাফরমানি।

সালাম কেবল মানুষের নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহর সম্ভাষণ। আল্লাহ তা’আলা জান্নাতবাসীদের সালাম দ্বারা স্বাগত জানাবেন। মানুষ জান্নাতে আনন্দে মশগুল থাকবে তখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে জান্নাতিদের সম্ভাষণ জানানো হবে এই বলে, “করুণাময় পালনকর্তার (পক্ষ) থেকে তাদেরকে বলা হবে ‘সালাম’। ” (সুরা ইয়াসিন: ৫৮)।

এটি নবী-রাসূলগণের সুন্নাত, খাঁটি মুমিনদের বৈশিষ্ট্য যা আদম (আঃ) থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। মহান রব মুসলিম জাতিকে সালামের শিক্ষা দিয়ে পবিত্র কুর’আনে ঘোষণা করেছেন, "হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যাতীত অন্য কারও গৃহে গৃহবাসীদের অনুমতি না নিয়ে ও তাদেরকে সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না। "(সূরা নুর: ২৮) সালাম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যে, মহান রব নিজের স্বজনদেরকেও সালাম দিতে আদেশ করেছেন, "যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে।

মহান রব সালাম বিষয়ে আরও বলেন, "যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা ওরই অনুরূপ কর। (সূরা নিসা: ৮৬)
এই সালাম কেবল পৃথিবীতে নয়, সালাম হবে জান্নাতবাসীদেরও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পদ্ধতি।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘যেদিন তারা তাঁর (আল্লাহর) সাথে সাক্ষাৎ করবে সেদিন তাদের অভিবাদন হবে সালাম আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন সম্মানজনক প্রতিদান” ( সুরা আহযাব: ৪৪)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তারা সেখানে (জান্নাতে) শুনতে পাবে না কোনো বেহুদা কথা এবং না পাপের কথা; শুধু এই বাণী ছাড়া, সালাম, সালাম’ ( সুরা ওয়াক্কিয়া: ২৫-২৬)।
সালাম দেয়া সর্বোত্তম ইসলামী কাজসমূহের একটি। হাদিসে এসেছে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামে কোন জিনিসটি উত্তম? তিনি বললেন, ‘তুমি খাদ্য খাওয়াবে ও চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দিবে।

(বুখারী, ১২, ২৮, ৬২৩৬; মুসলিম, ৪২)। সালামের প্রসার জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম : রাসূল(স.) বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, অভুক্তকে আহার করাও এবং রাতেরবেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ছালাত আদায় করো। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’।

(তিরমিযী, ২৪৮৫; ইবনে মাজাহ, ৩২৫১; সিলসিলা ছহীহাহ, ৫৬৯)। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে সালাম জান্নাতে প্রবেশকে আবশ্যক করে। আবু শুরাইহ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে এমন আমল বলে দিন, যা জান্নাতে প্রবেশকে আবশ্যক করে। রাসূল (স.) বললেন, ‘মিষ্টি কথা, সালামের প্রসার এবং মানুষকে খানা খাওয়ানো’।

(ইবনে হিব্বান, ৫০৪) সালামের প্রতি বাক্যে ১০টি সওয়াব বরাদ্দ রয়েছে। ইমরান ইবনু হুসাইন (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন নবী (স.)-এর নিকট এসে বললেন, আস-সালামু আলাইকুম।

তিনি তার জবাব দিলেন। লোকটি বসে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘১০ নেকী’। এরপর আরেকজন এসে বললেন, আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। নবী (স.) অনুরূপ জবাব দিলেন। লোকটি বসলেন। তিনি বললেন, ‘২০ নেকী’ অতঃপর আরেকজন এসে বললেন, আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। নবী (স.) তারও জবাব দিলেন। লোকটি বসলেন।

তিনি বললেন, ‘৩০ নেকী’। (আবুদাউদ, ৫১৯৫) শুদ্ধভাবে সালাম না দিলে এই সওয়ার পাওয়া যাবে কী? আগে সালাম দেওয়া ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি রাসূল (স.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক উত্তম ঐ ব্যক্তি যে আগে সালাম দেয়’। (আবুদাউদ, ৫১৯৭)।


আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জে আ.লীগের সাধারণ সম্পাদককে দেড় বছরের কারাদণ্ড


সালাম না দেয়াকে রাসূল (স.) কৃপণতা বলেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, যে সালাম দিতে কার্পণ্য করে তার চেয়ে বেশি কেউ কৃপন নয়’ (মিশকাত, ৪৬৬৫)

সালাম আল্লাহ ও তাঁর রসুল (স.) এর শিখানো মতে তথা আসসালামু আলাইকুম না বলা অনৈসলামিক। কাজেই শুদ্ধভাবে সালাম দেয়ার মধ্যে অন্য কিছু খুঁজে পাওয়া অযৌক্তিক ও এ বিষয়ে বেসামাল বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে এ নিয়ে প্রতিবাদ করার পর, সত্যটা উচ্চারণের পর বেসামাল বক্তব্য প্রদানকারী অনুতপ্ত না হলে জোর করে বিবৃতি আদায় কিংবা মামলা-মোকদ্দমা করাও কাঙ্ক্ষিত নয়।

ভুল-ত্রুটি ও ভালো-মন্দের মিশেলে মানুষের জীবন। কেউ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু কারো ভুলে তার প্রতি ক্রোধ দেখানো, রাগ ঝাড়া, জেদ-উত্তেজনা কিংবা উগ্র-কাতর হওয়া ভীষণ নিন্দনীয়। ক্ষমা মানুষের মান-মর্যাদা বাড়ায়। কাউকে ক্ষমা করে একজন সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠতে পারেন অসাধারণ মানুষ। কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ সম্মান বাড়িয়ে দেন। ক্ষমাশীল, সর্বোত্তম ব্যবহারকারী ও ধৈর্যশীল মানুষ আল্লাহ তা’আলার বিশেষ নেয়ামতপ্রাপ্ত। মহান আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল।
তিনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। যে অন্যকে ক্ষমা করে তাকেও ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন, "তারাই সংযমী, যারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় দান করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। " (সুরা আল ইমরান: ১৩৪)আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আদেশ দিয়েছেন, যেন একে-অপরকে ক্ষমা করে।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, "যদি তোমরা সৎকাজ প্রকাশ কর অথবা গোপন কর, কিংবা অন্যায় ক্ষমা কর, তাহলে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সর্বশক্তিমান। "(সুরা নিসা: ১৪৯)ক্ষমাকারীকে আল্লাহ তা’আলা বিশেষভাবে পুরস্কার দেবেন। পরস্পরের মধ্যে বিরোধ নিষ্পন্নকারীও আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। ” (সুরা শুরা: ৪০)

ক্ষমা করলে কারও মর্যাদা কমে না। বরং বহু গুণে ক্ষমাশীল ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আবু হুরায়রা (র.) থেকে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেন, ‘সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না।

যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম, ২৫৮৮)
আল্লাহ তা’আলা সবাইকে ক্ষমাশীল হওয়ার তাওফিক দান করুক।
অধ্যাপক জাকির হোসেন, সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

news24bd.tv কামরুল