সেই স্মৃতি

সেই স্মৃতি

আমিনুল ইসলাম

আজকাল মাঝে মাঝেই আমরা ভাই-বোনরা আমাদের ঢাকার বাসা নিয়ে কথা বলি।

নাখালপাড়া'র এই বাসাতেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

বাবা-মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন কয়েক বছর হয়ে গিয়েছে। আমরা ভাই-বোনরা অবশ্য এখনও এই বাসাকে কেন্দ্র করেই আছি।

বেশ পুরনো বাসা। আমারও জন্মের আগে আমার বাবা বানিয়েছিলেন। এখন অবশ্য আমরা ভাই-বোনরা যখনই এক সাথে কথা বলি, আমাদের কথার বিষয় থাকে- বাসাটা পুরনো হয়ে গিয়েছে। ভেঙে নতুন কিছু করতে হবে।

কিন্তু এই বাসায় যে হাজারো স্মৃতি।

বিশাল বারান্দা'র রেলিং এ ঝুলে কুমীর কুমীর খেলা। ঝড়-বৃষ্টি'র সময় যখন বিদ্যুৎ চলে যেত; তখন সবাই মিলে বারান্দায় আড্ডা দেওয়া। কখনো চানাচুর ওয়ালার কাছ থেকে দুই টাকার চানাচুর কিনে খাওয়া।

নিচ তলার লম্বা বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রিকেট খেলা। এই ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কতো বকা খেয়েছি নিচ তলার আন্টি'র কাছে!

আচ্ছা, স্মৃতি গুলো কি শুধু'ই আমাদের? 

আমাদের বাসায় যারা ভাড়া ছিল; তারা তো কয়েক যুগ আমাদের বাসায় থেকেছে! তাদের মাঝেও কি এইসব স্মৃতি গুলো আঁটকে নেই?

শুনেছি অন্য পাশের নিচ তলার আপু'টা এখন ডাক্তার। কোনো এক বিচিত্র কারণে ওনাকে খুব ভয় পেতাম! কে জানে, হয়ত নিচে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে খুব শব্দ করার কারণে প্রায়'ই বকা খেতে হতো; এই জন্য হবে হয়ত।

এই আপু'র সাথে কী এক জীবনে আর কোনো দিন দেখা হবে না? আমার তো জানাও নেই; ওনারা এখন কোথায় থাকে! ওনার ছোট ভাই'টা অবশ্য আমাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত মাঝে মাঝে'ই। শুনেছি ছেলেটা এখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। এই পর্যন্ত'ই! জানা নেই, কোথায় আছে এরা!

আমাদের নাখাল পাড়া'র একটা অদ্ভুত আবেদন আছে। ছোট ছোট গলি, আর প্রতিটা গলি'র মোড়ে'ই মুদির দোকান। সবাই, সবাইকে অল্প কিছু হলেও চেনে।  

এইবার যখন দেশে গিয়েছি, বেশ কয়েকবার নতুন ঢাকার উত্তরায় যাবার সুযোগ হয়েছে। গিয়ে মনে হয়েছে- সেখানকার সংস্কৃতি পুরো'ই ভিন্ন। যে যার মতো চলছে। পাশের বাসায় কারা থাকে; সেটাও হয়ত কেউ ভালো করে জানে না।  

আমাদের নাখাল পাড়ায় অবশ্য আমরা যখন বড় হয়েছি; শুধু নিজেদের গলি নয়, আশপাশের অনেক গলিতে কারা থাকতো; কে কি করছে; সব খবর'ই আমরা পেয়ে যেতাম। সবাই-সবার খবর রাখত।

আশপাশের মুদি দোকানদার'রা আমাদের মতো ছোটদের তুই করেই বলত। একটা চমৎকার সম্পর্ক ছিল। এইতো, এই ডিসেম্বরে যখন শেষ বারের মতো দেশে গিয়েছি; আমি আমাদের গলির মোড়ে'র দোকানদার কাওসার মামা'র জন্য চকলেট নিয়ে গিয়েছিলাম। ওনাকে আমরা ভাই-বোনরা মামা'ই বলতাম।

দেশে গিয়ে দেখি- ওনার দোকান'টায় নতুন মানুষ! সেখানে এখন শাক-সবজি, আলু-পটল বিক্রি হয়! পাশের দোকানদার'কে জিজ্ঞেস করেছি 

-কাওসার মামা কোথায়? 
-শরীর খারাপ করাতে আর থাকতে পারেনি। গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে!

শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা, এক জীবনে ওনার সাথে কি আর কখনো দেখা হবে? পুরো জীবন দোকান করেও মানুষটার হয়ত ঢাকায় থাকার কোনো স্থায়ী জায়গা হয়েনি। তাই ফিরতে হয়েছে নিজ গ্রামে আপন ঠিকানায়।

আমাদের বিশাল বারান্দা দিয়ে মাঝে মাঝে দেখতাম দুই বাসা পরে সরওয়ার (মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী) ভাইদের বাসার ছাদে মাঝে মাঝে'ই পাড়ার অনেক ছেলেরা আড্ডা দিত। ওনার একটা বড় ভাই ছিল, যিনি মনে হয় কোনো ব্যান্ড দল করতেন কিংবা কে জানে করতেন কিনা! তবে মনে আছে একবার ওনাদের ছাদে- ব্যান্ড সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়েছিল। তখনও আমরা বেশ ছোট। কিন্তু আমাদের বাসার বারান্দা থেকে'ই আমাদের সেকি উত্তেজনা! 

সরওয়ার ভাই'র মা মারা গিয়েছেন শুনেছি। বাবা বেঁচে আছেন কিনা এখনও ঠিক জানা নেই। আহা, মানুষটা হাত পকেটে দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন গলিতে। বিয়ের পর শুনেছি নাখাল পাড়ার বাসা ছেড়ে বনানীর কোন ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছেন সরওয়ার ভাই। বনানীর পশ এলাকায় হয়ত উঠেছেন, কিন্তু নাখাল পাড়ার আমাদের সেই গলি, গলি'র মোড়ে আড্ডা দেওয়া; আশপাশের দোকান এইসব কি এতো সহজে ভোলা সম্ভব? 

পাশের বাসার বাড়িওয়ালার দুই মেয়ে। এরা অবশ্য আমার বয়েসি'ই। মনে আছে আঙ্কেল-আন্টি সব সময় ওদের বকা দিত আমাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে! কারণ আমি বরাবর'ই মোটামুটি ভালো ছাত্র ছিলাম। বোধকরি এই দুই মেয়ে এই জন্য আমাকে খুব একটা পছন্দ করতো না। আমার অবশ্য এই নিয়ে কখনোই কোনো আক্ষেপ ছিল না। কারণ আমি বরাবর'ই বেশ অন্তর্মুখী ছিলাম।

এদের একজন পাশের বাড়ি'র এক ভাড়াটিয়া ছেলের সাথে প্রেম করে বসলো! সেকি কাণ্ড! এই নিয়ে আমার বাবা-মা আর আঙ্কেল-আন্টির কতো কী আলোচনা! 

ছিঃ ছিঃ, জাত গেল! মেয়ে প্রেম করছে! ছিঃ ছিঃ! করবি কি তো কর বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে কর! ভাড়াটিয়ার ছেলেরে সাথে কেন! 

শেষমেশ এই ছেলের সাথেই মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা অবশ্য সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে এখন ডাক্তার হয়েছে। আমাদের নাখাল পাড়াতে তার একটা চেম্বার আছে।  

সেবার দেশে গিয়ে শরীর খারাপ হয়েছিল। ওনার চেম্বারে গিয়েছিলাম। দেখে মনে হলো; ভালো করে চিনতে'ই পারছে না! খুব অবাক হয়েছিলাম। অথচ আমি স্রেফ পরিচত মানুষ বলেই তার কাছে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় বলেছিলাম - আমি মাঝে মাঝে পত্রিকায় কলাম লিখি। এরপর দেখি উনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছেন! 

বার বার ভাবছিলাম- আমি ব্যক্তি মানুষটাকে তিনি একটুও গুরুত্ব দেন'নি! ডাক্তার হয়ে কি তাহলে আশপাশের মানুষকে ভুলতে বসেছেন তিনি! অথচ যেই না বললাম- আমি পত্রিকায় লিখি। তখন বেশ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন।  

পলাশদের কথা তো বলাই হলো না। শুনেছি আজকাল বেশ নাম-ডাক হয়েছে পলাশের। নাটক-টাটক বানায়। অভিনয়ও করে। কাবিলা চরিত্র করে ওর নাম'ই নাকি কাবিলা হয়ে যাবার মতো অবস্থা! আমিও আজকাল ওর নাটক দেখি সময় পেলেই।  

আহা, নিচ তলায় এক সঙ্গে কতো ক্রিকেট খেলেছি। আমার মনে আছে বৃষ্টি'র দিনে মাঝে মাঝে'ই দেখতাম নিচ তলার সামনের জায়গাটায় পানি জমে যেত। পলাশের কাজ ছিল নৌকা বানিয়ে খেলা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা ছেলে কী করে নৌকা বানিয়ে খেলতে পারে; এটা ভেবে'ই মাঝে মাঝে অবাক হতাম।  

ওর আম্মা, মানে নিচ তলার আন্টিকে অবশ্য আমি ভয় পেতাম। কারণ নিচের লম্বা জায়গাটাতে আমরা খেলাতাম। পলাশ, আমি এবং অন্য পাশের ছেলেটা; ওর নামটা এখন আর মনে পরছে না, সোহান না সজীব হবে হয়ত; আমরা খেলতাম আর ইচ্ছে মতো শব্দ করতাম। তাই আন্টি এসে মাঝে মাঝেই বকা দিতেন।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর