এ পৃথিবী একবার পায় তারে...

এ পৃথিবী একবার পায় তারে...

মাজহারুল ইসলাম

প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে দেশে বা বিদেশে বেড়াতে খুব পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৯-এর জানুয়ারি থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ-বিদেশে যেখানেই যতবার তিনি বেড়াতে গেছেন, দু-চারবার ছাড়া প্রতিবারই একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি।

২০০২ সালে হুমায়ূন আহমেদ আর আমি ৯ দিন ঘুরে বেড়িয়েছি জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালিতে। জার্মানিতে একটা বইমেলায় অংশ নিতে আমরা গিয়েছিলাম।

সেখান থেকে অন্য দুই দেশে যাওয়া। ওই বেড়ানোটা ছিল আমার জন্য স্মরণীয় একটি ঘটনা। বহু দেশ, অসংখ্য জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি একসঙ্গে। কিন্তু ওই বেড়ানো ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।

কলকাতা ও দার্জিলিং ছাড়াও মেঘালয়, ত্রিপুরা, সিকিমের নানা শহর ও পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি তার সঙ্গে। নেপালে গেছি কমপক্ষে ১০ বার।

কখনও শুধু ব্যাচেলর, কখনও পরিবার-পরিজনসহ। একবার শুধু স্যার, নূহাশ ও আমি গিয়েছিলাম নেপালে। সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন আর থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গা যুক্ত হয়েছে আমাদের যৌথ অভিজ্ঞতায়। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সফরের সঙ্গী হয়েছি বহুবার।
দেশের ভেতরে যেখানে তিনি গেছেন, সঙ্গে আমার যাওয়াটা ছিল অবধারিত। কয়েকশ' দিন ও রাত কাটিয়েছি তার সানি্ধ্যে নূহাশ পল্লীতে।


আরও পড়ুন:আগামী ৫ দিন গতি কমতে পারে ইন্টারনেটের


জোছনা দেখা, শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভেজা, চৈত্রের প্রচণ্ড দাবদাহে সুইমিংপুলের পানিতে ডুবে থাকা, গাছ থেকে লিচু পাড়া, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা, ক্ষেতের ধান কাটা ইত্যাদি নানা উৎসব।

নাটক-সিনেমার শুটিং তো আছেই। এছাড়াও নতুন নতুন উপলক্ষ তৈরি করে সবসময় আনন্দ করতে পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ।
১২ বছরের অধিক সময় পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেছি আমরা। 'গর্তজীবী' হুমায়ূন আহমেদ সারা দিনই বাসায় থাকতেন।

সচরাচর কোথাও বের হতেন না, নূহাশ পল্লী ছাড়া। প্রায়ই সকালে ঘুম থেকে উঠে একসঙ্গে চা খাওয়া অথবা অফিসে আসার পথে একবার তার সঙ্গে দেখা করে বের হওয়া এবং সন্ধ্যায় বা রাতে যখনই দখিন হাওয়ায় ফিরি, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখা করে ঘরে ফেরা। কখন কীভাবে এই অভ্যস্ততায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজেই জানি না।

প্রায় প্রতি রাতে একসঙ্গে খাওয়া ছিল নিয়মিত একটা বিষয়। মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদ বাজার করতে পছন্দ করতেন। কোনো দিন হয়তো বাজার থেকে একটা বড় চিতল বা পাবদা মাছ কিনে আনলেন। আমি তখন অফিসে।

সঙ্গে সঙ্গে ফোন করতেন, মাজহার, নিউমার্কেট থেকে বড় একটি চিতল মাছ এনেছি। দুপুরে একসঙ্গে খাব, চলে এসো। কাজের ব্যস্ততায় কখনও যেতে পারতাম, কখনও পারতাম না। যেতে না পারলে রাতে অবশ্যই তার সঙ্গে খেতে হতো। খেতে বসে দেখি সেই চিতল মাছ।

বলতেন, তুমি চিতল পছন্দ করো। তাই বড় টুকরাটি রেখে দিয়েছি তোমার জন্য। ...এরকম ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে।
হুমায়ূন আহমেদ আমাকে একটি বই উৎসর্গ করেন।

বইটির নাম কুহুরানী। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, 'একজীবনে অনেক বই লিখেছি। প্রিয় অপ্রিয় অনেককেই উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রায়ই ভাবি, কেউ কি বাদ পড়ে গেল? অতি কাছের কোনো বস্তুকে ক্যামেরা ফোকাস করতে পারে না। মানুষও ক্যামেরার মতোই।

অতি কাছের জন ফোকাসের বাইরে থাকে। ও আচ্ছা, পুত্রসম মাজহার বাদ পড়েছে। ' বিভিন্ন সময় পরিচিত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে এভাবেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন।

আসলে তার সঙ্গে আমার একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কখনও ছিল ভ্রাতৃসম্পর্ক, কখনও পিতৃসম্পর্ক, আবার কখনও তা গভীর বন্ধুত্বের। তখনও ভেবেছি, এখন আরও বেশি করে ভাবি--কী অদ্ভুত সম্মোহনে তিনি আমায় কাছে টেনেছিলেন! সর্ব অর্থেই তিনি একজন জাদুকর ছিলেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমজনতা জানে তাকে গল্পের জাদুকর হিসেবে। কেউ কেউ এও জানেন, তিনি ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ানসের সদস্য ছিলেন। বন্ধুদের আড্ডায় তিনি কখনও কখনও নানারকম জাদু দেখাতেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার জাদুতে জুয়েল আইচও মুগ্ধ হয়েছেন বহুবার।
আর একটি জাদু জানতেন তিনি- কাউকে আপন করে নেয়ার জাদু।

সেই জাদুতেই আমি আচ্ছন্ন হই।
স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, দুই পুত্র নিষাদ ও নিনিত এবং আমাকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তার 'ষষ্ঠ সংসার' পেতেছিলেন নিউইয়র্কে। সে সংসারে আরেক নিয়মিত সদস্য ছিলেন শাশুড়ি তহুরা আলী। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গিয়ে শুরু হয়েছিল এ সংসার। তিন রুমের একটা আলাদা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হলো। হাঁড়ি-পাতিল কেনা হলো। টিভি কেনা, বিছানা-বালিশ- সে এক বিরাট হৈচৈ।

চিকিৎসা শুরু হলো। ১২টি কেমো দেওয়ার পর অপারেশনের আগে তিন সপ্তাহের জন্য তিনি দেশ থেকে ঘুরে এলেন। ১২ জুন তার অপারেশন হলো। ১৯ জুন ফিরে এলেন জ্যামাইকার বাসায়। দু'দিন পর অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে।

২১ জুন হলো দ্বিতীয় অপারেশন। ২৯ জুন রাতে ডিলেরিয়াম হলে পরদিন থেকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেয়া শুরু হলো। এ প্রক্রিয়াটি শারীরিকভাবে অস্বস্তিকর বলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো।

১২ থেকে ১৯ জুন এবং ২১ থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত প্রতি রাতে একদিন শাওন ভাবি, একদিন আমি হাসপাতালে থাকতাম। অধিকাংশ রাতেই হুমায়ূন আহমেদ ঘুমাতে পারতেন না।

কেমোর কারণে হাত-পায়ের আঙুলে একধরনের অস্বস্তি বোধ করতেন। প্রায় সারা রাতই হাত-পা-মাথা টিপে দিতে হতো।
কখনও বলতেন, মাজহার, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।

এ কাজটি কখনোই শাওন ভাবি ছাড়া কাউকে দিয়ে করাতেন না তিনি। শারীরিক অস্বস্তি, ঘুমের ওষুধ দেওয়ার পরও ঘুম না আসার কষ্ট অথবা মাজহার তো আমার পুত্রের মতোই, সেই বোধ থেকেই হয়তো আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে বলতেন। আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব গভীর মমতা দিয়ে তার অস্বস্তি দূর করতে।

চোখ বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে গেলে হয়তো পাশের চেয়ারটায় বসেছি, ১০ মিনিট না হতেই ঘুম ভেঙে যেত তার। আবার সেই আকুল করা স্বর, মাজহার, ঘুম পাড়িয়ে দাও। সেই স্বরের মধ্যে কী যে স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা আর আকুতি ছিল, আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব নয়।

যে ভালোবাসা, স্নেহ ও মমতা আমি পেয়েছি তার ঋণ শোধ করার আগেই এলো ১৯ জুলাই, সেই ভয়ঙ্কর দিন। প্রচণ্ড ভয়াবহতায় দুলে উঠল আমার পৃথিবী।
'সপ্তম সংসারে' পাড়ি জমালেন হুমায়ূন আহমেদ। যে সংসারের কথা তিনি লিখেছেন এভাবে, 'সম্ভবত সপ্তম সংসার হবে আমার শেষ সংসার।

সেখানে কি আমি একা থাকব, নাকি সুখ-দুঃখের সব সাথীই থাকবে?' [নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, পৃষ্ঠা-১৫। ] সপ্তম সংসারে তিনি একা নন। সেখানে আছে তার পুত্র রাশেদ হুমায়ূন, কন্যা লীলাবতী; পিতৃস্নেহ পায়নি যারা একটি দিনের জন্যও। আছেন মাতা আয়েশা ফয়েজ, পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ।

বন্ধু আনিস সাবেত, প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বগুড়ার স্কুলজীবনের বন্ধু সেহেরী আর প্রিয় অভিনেতা চ্যালেঞ্জারও আছেন সেখানে। কোনো কোনো সংসারে এরাই তো ছিলেন তার সুখ-দুঃখের সাথী।

একই গ্রন্থের ৩১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, 'আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দুটি ছেলে নিতান্ত অল্প বয়সে হোয়াইট হাউসে মারা যায়। আব্রাহাম লিংকন তারপর হতাশ হয়ে লিখলেন, গডের সৃষ্টি কোনো জিনিসকে বেশি ভালোবাসতে নেই। কারণ তিনি কখন তার সৃষ্টি মুছে ফেলবেন তা তিনি জানেন।

আমরা জানি না। '
বিধাতা কেন এত অকরুণ! প্রিয়জন যদি চলেই যাবে চিরতরে, তবে কেন এ মিছে মায়ায় জড়ানো!
মাজহারুল ইসলাম, প্রকাশক।  

 

news24bd.tv তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর