মহানবীর পথ

মহানবীর পথ

চৌধুরী জহিরুল ইসলাম

জগতে যদি পাপের কোনো বিষয় থাকে, সেটা হলো মানুষকে ছোট করে দেখা। ধর্ম, দর্শন, খ্যাতি, যশ, ধন-দৌলত, জাত, বংশ নির্ধারণে মানুষকে ছোট বিবেচনা করা। মানুষের বিশ্বাসকে অবমাননা করা। ইচ্ছে করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে মজা লোটা।

মানুষের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদ তৈরি করা।

ফ্রান্স একটি মহান দেশ। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব মহান করে রেখেছে দেশটিকে। ফরাসি বিপ্লবের ধাক্কা লাগে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে।

আমেরিকার স্বাধীনতা লাভে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ফ্রান্সের। ১৭৮৬ সালের স্বাধীনতার শতবর্ষ স্মরণে নিউইয়র্ক উপ-সাগরের স্ট্যাচু অব লিবার্টিও দিয়েছিল ফ্রান্স ১৮৮৬ সালে। বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম, সিভিল রাইটস মুভমেন্ট সব ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবের মহান বাণীগুলো ছিল আমেরিকার বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র। সেই মূলমন্ত্র ছিল- ইকুয়েলিটি, লিবার্টি এবং ফ্রিডম।

আজ ফ্রান্সে যখন স্বাধীনতার মর্মবাণী পথ হারায়, তখন বুঝতে হবে পৃথিবীর সর্বত্র সমতা, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিপদের মুখে। ২০১৫ সালে শার্লি আবদু ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি কার্টুন ফ্রান্সে সাম্প্রদায়িকতার বাতাসকে ভারি করেছিল। ফ্রিডম অব স্পিচ পড়াতে গিয়ে সেই কার্টুনকেই ক্লাসরুমে প্রদর্শন করলেন এবার স্যামুয়েল প্যাটি নামের এক স্কুল শিক্ষক। বাতাস আবার বিষাক্ত হয়ে গেল। মস্কোয় জন্ম নেওয়া ১৮ বছরের এক চেচেন যুবক সেই শিক্ষককে হত্যা করলো স্কুলের বাইরে।

একজন শিক্ষকের বিবেচনা বোধ কতটা পরিমিত হলে তিনি কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেয়ার আগে চিন্তা করবেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু একজন মানুষকে হত্যা করা কোনো যুক্তিতেই ধর্মীয় কাজ হতে পারে না। এই নিন্দা প্রকাশটাও চাপা পড়ে গিল ধর্মীয় উন্মাদনা ও রাজনীতির সহিংসতায়। একটি রাষ্ট্রে নাগরিকদের সম্প্রীতি বহুলভাব নির্ভর করে রাষ্ট্রের পরিচালকদের উপর। ফ্রান্সে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের বেশি। বেশ কিছুকাল ধরে মুসলমানদের কোনঠাসা করে রাখার একটা প্রয়াস চলছিল দেশটির দক্ষিণ পন্থী রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে।

প্রথমে তারা মুসলিম নারীদের হিজাব নিষিদ্ধ করেন। পরে ধর্মীয় সমাবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করে মুসলমানদের অসন্তুষ্ট করেন। আবার শিক্ষককে হত্যার পর প্যারিসের সরকারি ভবনে নবী মোহাম্মদের ব্যাঙ্গচিত্র টানিয়ে দেয়া হয়। এসব ঘটনা কেবলি উস্কানিমূলক!
এরপর গত শুক্রবার দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রন প্রকাশ্য জনসভায় বলেন- Islam is "a religion that is in crisis all over the world" এর অর্থ “ইসলাম সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি সমস্যা। ” তার এ মন্তব্যের পর বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

বিশ্বে শুধু মুসলমান নয়, আরো বহু ধর্মীলম্বী আছে। স্বকীয়তা ও স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করতে চায় সবাই। সব ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার সম্পর্ক যাতে অটুট থাকে, সে চেষ্টাই করেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদরা কখনো সম্প্রীতির বাতাবরণকে নষ্ট করেন না। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম তার উল্টো!

আমেরিকা আছি গত প্রায় দুই দশক। ২০০১ সালে নাইন এলিভেনের পর একটি মহল চেয়েছিল- আমেরিকান সমাজ থেকে মুসলমানদের পৃথক করতে, পারেনি। আমেরিকান সমাজ ধর্মকে যুক্তিযুক্তভাবেই রাজনীতি থেকে পৃথক রেখেছে। তথাপি সে সময় প্রেসিডেন্ট বুশ মসজিদে গিয়ে মুসলমানদেরকে আশ্বস্থ করেছেন। অভয় দিয়েছেন।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর সাতটি মুসলিম দেশকে বয়কট করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। আমেরিকার মিডিয়া এবং বিজ্ঞজনেরা প্রেসিডেন্টকে নিবৃত্ত করেছে। আমরা সেক্যুলার রাষ্ট্র চাই। সেক্যুলার মানে সব ধর্মের সমান স্বাধীনতা। মানুষের জীবন-যাপন, রুচি ও সংস্কৃতিতে রাষ্ট্র কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। মানুষের বিশ্বাস এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধাবোধ থাকবে।

হিজাব পরা, ধুতি লুঙ্গি পরা, কিংবা পেন্ট-টাই পরায় কেউ কাউকে বাঁধা দেবে না। এক মানব জাতি হিসাবে সবাই সবার কাছে হবে সম্মানিত। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের প্রায় আড়াইশ বছর পরও সম্ভবত আমরা মানবজাতি সেই সীমাবদ্ধতা উতরে যেতে পারিনি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের বিরোধিতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন- “ম্যাক্রন মানসিক রোগী। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। ” তিনি এমনকি ফরাসি পণ্য বর্জনেরও আহবান জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য সহ প্রতিটি মুসলিম দেশ এরদোয়ানকে সমর্থন করছে বলে মনে হয়। আবার ইউরোপ দাঁড়িয়েছে ম্যাক্রনের পক্ষে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের অপরিনামদর্শী কথাবার্তায় দেশটি এখন গ্যাঁড়াকলে আটকেছে। তুরস্ক হলো ফ্রান্সের সপ্তম বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। ফরাসি পণ্য বর্জন শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়বে দেশটি। ইউরোপ ও মুসলিম দেশগুলোর এই পারস্পরিক বিরোধিতা মুখে ফ্রান্সের মুসলিম ফেইথ কাউন্সিল একটি বিবৃতি দিয়েছে। তারা তাতে বলেছে- "France is a great country, Muslim citizens are not persecuted, they freely construct their mosques and they freely practice their religion,"  অর্থাৎ ফ্রান্স একটি মহান দেশ। মুসলমান নাগরিকরা এখানে নির্যাতিত নয়। মুসলমানরা স্বাধীনভাবেই তাদের মসজিদ নির্মাণ করে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করছে।

কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মেদ মোসাওয়ি মুসলিম জনগণকে ফরাসি জাতির পক্ষে দাঁড়াবার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ফ্রান্সের আইন নবীর বিদ্বেষমূলক ব্যাঙ্গচিত্রকে ‘ঘৃণা করার’ অধিকারও দিয়েছে। ধর্ম উন্মাদনা এবং জাত্যাভিমান ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শিক্ষার জন্ম দেয়। তেমন একটি শিক্ষা আমরা পেয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। নাজি বর্বরতায় লাখ লাখ ইহুদী হলোকাস্টে প্রাণ হারিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিষময় ক্ষত থেকে মানবজাতি এখনো মুক্তি পায়নি। ধর্মবিদ্বেষের পরিণামে যেন নতুন কোনো ক্ষতের আর জন্ম না হয়।


আরও পড়ুন: বয়কটের চেয়ে আত্মসমালোচনা জরুরি


প্রতিদিন তিনটি মিডিয়ার খবর আমি দেখি। আমেরিকান মিডিয়া ব্যস্ত নির্বাচন নিয়ে। ভারতের মিডিয়া ফলাও করে দেখাচ্ছে মুসলমানদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ। একই সঙ্গে মোদি এবং ম্যাক্রনের আলিঙ্গনের ছবি। মুসলমানদেরকে ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। আর বাংলাদেশে ম্যাক্রনের ছবি পদদলিত করা কিংবা ছবিতে আগুন লাগিয়ে উল্লাস প্রকাশ। মহানবীর ব্যাঙ্গচিত্র নিন্দনীয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন শিক্ষককে হত্যা, গীর্জায় ঢুকে নিরীহ মানুষ হত্যা কি কম কাপুরুষোচিত?

মহানবী আজ জীবিত থাকলে নিশ্চয় মুসলমানদেরকে সংযম ও ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আমাদের অন্তরে মহানবী আসলে জীবিত নেই। আমরা আনুষ্ঠানিকতানির্ভর এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছি। মহানবীর মহান বাণী আমাদের জীবনাচারে প্রতিভাত হয় ক্বদাচিৎ! হয়ত ভবিষ্যতে আরো হাজার হাজার ব্যাঙ্গচিত্র আঁকা হবে। প্রকৃত মুসলমান এবং ধর্মভীরু মানুষ কি তাতেই লাফিয়ে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?  তাতে কি ইসলামের সামান্যতম উপকার হবে? মহানবী কি তাতে খুশী হবেন?

আমরা জানি ইসলাম প্রচারের সময় বিধর্মীরা নবী মোহাম্মদকে গালিগালাজ, এমনকি তার পথ চলার সময় ইস্টক বর্ষণ করতো। ইবাদতখানায় পায়খানা-প্র্স্রাব করে যেত। তথাপি তিনি কারো প্রতি রুষ্ট হতে নিষেধ করতেন। যারা তাঁকে অপমান করতো, তাঁরাই পরবর্তিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো। আমরা কি এখনো একই ধৈর্য ও সহনশীলতার পথ অনুসরণ করতে পারি না? তাতে কি মুসলমানের সামান্যতম ক্ষতি হবে?

লেখক: চৌধুরী জহিরুল ইসলাম, নিউইয়র্ক।

(মত ভিন্ন মত বিভাগের লেখার আইনগত ও অন্যান্য দায় লেখকের নিজস্ব। এই বিভাগের কোনো লেখা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। )

news24bd.tv আহমেদ

সম্পর্কিত খবর