মায়ের কোনো সঙ্গী ছিল না

মায়ের কোনো সঙ্গী ছিল না

জসিম মল্লিক

আজ আমার মাথায় ঘুঘু ডেকেছিল। এই ঘুঘু কথাটা মা বলতেন আমাকে। মায়ের সাথে অনেক এলেবেলে গল্প করতাম আমি। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর পান খেয়ে মা ঠোঁট লাল করে বিছানায় গাড়াগড়ি যেতেন।

মায়ের ছোট্ট সেই ঘর। বিছানায় প্রিন্টের চাদর, বালিশ, লাল টেবিল ক্লথ, তার উপর পানের সরঞ্জাম, দেয়ালে পাল তোলা নৌকার ক্যালেন্ডার, জানালায় সতেজ পেয়ারার ডাল। মা পড়তে পারতেন না কিন্তু আমাকে বলতেন ক্যালেন্ডার এনে দিতে। আমি এনে দিতাম।

কলেজে পড়ার সময় আমি অনেক চিঠিপত্র লিখতাম। পেনফ্রেন্ড করতাম। শত শত চিঠি জমে উঠত। মা প্যাকেট করে যত্ন করে সেই চিঠি রেখে দিতেন। কলেজ থেকে এসে কখনো কখনো মায়ের পাশে শুয়ে পড়তাম। আরাম করে চিঠির খাম খুলতাম। কখনো কখনো নিজের অজান্তে মুখে হাসি ফুটে উঠত। মা খেয়াল করতেন।

-কারা তোমাকে চিঠি লেখে!
-মেয়েরা!
-সব চিঠি মেয়েরা লেখে!
-ছেলেরাও লেখে।
-মেয়েরা কি লিখে তোমাকে!
-অনেক কিছু লেখে। সব বলা যাবে না।

মা ঘাবরে যায় আমি টের পাই। মাকে আরো ভড়কে দেওয়ার জন্য বলি, ভয় পাইয়েন না, আমাকে কোনো মেয়ে পছন্দ করবে না।
-কেনো করবে না! তুমি কত ভালো ছেলে।
আমি হেসে বলি, আমার মাথার কোনো ঠিক নাই।
-কে বলছে তোমার মাথা ঠিক নাই!

আমি সারাদিন গল্পের বই পড়ি. চিঠি লিখি। সিনেমা দেখি। আমি তো ডাক্তার ইঞ্জনিয়ার কিছু হব না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অনেক টাকা লাগে। কে দেবে সেই টাকা! তাই আমাকে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না মা।
-তোমার জন্য ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে আসব।
-আনলেও থাকবে না, ভেগে যাবে হিহিহি..।
তখন মা বলত, তোমার মাথায় আবার ঘুঘু ডাকছে।

আরও পড়ুন: বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা

হ্যাঁ সত্যি আজও আমার মাথায় মাঝে মাঝে ঘুঘু ডাকে। যখন মাথা আউলা ঝাউলা লাগে তখন আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে পরি। আজকে সন্ধ্যার আবছায়ায় বাড়ি থেকে একটু দূরেই সাদারল্যান্ড রোড ধরে যাচ্ছিলাম। এই রাস্তাটার কথা আগেও লিখেছি। একটা মন কেমন করা রাস্তা এটা। আজকাল এমন হয়েছে ধপ করে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ে। হুট করে সন্ধ্যা নেমে আসে। সাদারল্যান্ড রাস্তাটার একটা ভুতুরে ব্যাপার আছে। তাছাড়া নভেম্বরের এই সময় গাছের পাতারা সব ঝড়ে গেছে। সর সর করে বাতাসে পাতারা যখন ওড়ে, তখন একটা অশরীরি ব্যাপার ঘটতে থাকে চারিদিকে। ভুতের মতো, প্রেতের মতো। এই এলাকাটা একটু ধনাঢ্য মানুষদের। সন্ধ্যার পর এরা ঘরের বার হয় ক্কচিৎ।

আমি আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। তিরিশ কিলোমিটার জোন এটা। একটু একটু পর স্পীডিং মেশিন বসানো। মাস কয়েক আগে এই রাস্তায় আমাকে পুলিশ গাড়ি পুলওভার করেছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম টিকিট ধরিয়ে দেবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড আমাকে একটা ওয়ার্নিং চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে শুধু। মেরামতির কাজ হচ্ছে রাস্তাটায়। মেশিন পত্র পড়ে আছে। আমি সাদারল্যান্ড ধরে সোজা চলে যাব ব্রডওয়ে পর্যন্ত। ব্রডওয়েতে লেফট নিয়ে যেতে থাকলে বে ভিউ। সেখানে ESSO গ্যাস স্টেশন থেকে কফি নিয়ে যখন ফিরছি তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়েছে। রাস্তায় কোনো লাইট নাই। এখানকার নেইবারহুডগুলোতে কোনো স্ট্রীট লাইট থাকে না।

আরও পড়ুন: ট্রাম্প বললেন, রাত ৮টার পর যত ভোট পড়েছে তা অবৈধ

আজ আমার কোনো তাড়া নাই। আধো অন্ধকারে দেখতে পাই এক জোড়া দম্পতি ধীর লয়ে হাত ধরে হাঁটছে ওয়াকওয়ে দিয়ে। বয়স আনুমানিক পঁচাত্তুর বা আশি হবে। মুখে ভালোবাসা ও প্রশান্তির আভা। কথা বলছে দু’জনে। ঠিক তখনই আমার মানসচোখে মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। এ রকম বয়সে মা কখনো কোনো পুরুষের হাত ধরে হাঁটেনি। মায়ের কোনো সঙ্গী ছিল না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের নির্ভরতার জায়গা। মায়ের অতি গোপন কষ্টের কথা বলার কেউ ছিল না। মা অনেক অল্প বয়সে স্বামীহারা হন। আমার বয়স যখন দুই। আর আমি এখন ঊনষাট!

টরন্টো ৭ নভেম্বর ২০২০-

লেখক, সাংবাদিক, কানাডা

news24bd.tv তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর