আমিও জানি আমি খুব বোকা

আমিও জানি আমি খুব বোকা

তসলিমা নাসরিন

আজকাল নিঃস্বার্থ মানুষ পাওয়া যায় না। মানুষ স্বার্থটা এত ভালো বোঝে যে বিশ্বাসই করতে পারে না পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছে যারা স্বার্থ দেখে না। শৈশব-কৈশোরে যারা আমার সহপাঠী বা বন্ধু ছিল, যারা ডাক্তারি পড়েছে, পাশ করেছে আমার সঙ্গে, আমার আগে বা পরে, সবাই বিশাল ধনী। দেশে-বিদেশে তারা অট্টালিকা বানিয়েছে, বাগান বাড়ি বানিয়েছে।

রাজার হালে বাস করে একেকজন। আমার কিন্তু মাথার ওপর ছাদ নেই, পায়ের তলায় মাটি নেই।

আমি তো নামী  হাসপাতালের ডাক্তার ছিলাম, আমি তো জনপ্রিয় লেখক ছিলাম, যাকে মোটা অংকের অগ্রীম রয়্যালিটি দিয়ে যেত প্রকাশকেরা। আমার এই দুর্দশা কেন? ওই একটাই কারণ, নিজের কথা মোটেও ভাবিনি, সমাজকে সুস্থ, সুন্দর এবং সভ্য করব, নারীর সমানাধিকার আনব, সবাইকে বিজ্ঞানমনস্ক করব, এই স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, অনেকটা  হাঙ্গর ভরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো।

লক্ষ করেছি, যখন সংখ্যালঘু হিন্দুর অধিকারের কথা বলেছি, হিন্দু বিরোধী লোকেরা দোষ দিয়েছে, হিন্দু মৌলবাদিদের টাকা খেয়ে নাকি বলেছি। যখন পাকিস্তানে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের বাঁচার অধিকারের কথা লিখেছি, তখন খ্রিস্টানবিরোধী লোকেরা দোষ দিয়েছে, খ্রিস্টান মৌলবাদিদের টাকা খেয়ে লিখেছি। যখন জিহাদি মৌলবাদী গোষ্ঠীর বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছি, তখন জিহাদি সমর্থকরা, এমনকি যারা সমর্থক নয় তারাও দোষ দিয়েছে,  হিন্দু বা খ্রিস্টান বা ইহুদিদের টাকা খেয়ে সরব হয়েছি। যখন গুজরাটের মুসলিম বা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলেছি, অনেকে দোষ দিয়েছে আরব দেশের  টাকা খেয়ে বলেছি। যখন সমকামীদের অধিকারের পক্ষে লিখি, তখনও বলে পাশ্চাত্যের টাকা খেয়ে লিখি। মানবতার কথা, মানবাধিকারের কথা  লিখলেও ওই একই বদনাম, কোথাও থেকে টাকা পেয়েছি, তা না হলে লিখবো কেন। তারা বুঝে পায় না, টাকা না পেলে এসব বিষয়ে কেন রুখে দাঁড়াবে কেউ।

মানবাধিকার সংগঠনের লোকেরা দাঁড়ায়, এসব তাদের এজেণ্ডা বলেই দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে টাকা পায় বলে দাঁড়ায়। এনজিওর লোকেরাও তাই করে। কিন্তু একা একজন লেখক  কেন দাঁড়ায়? ঘরের খেয়ে বনের মোষ যে কেউ কেউ তাড়ায়, এ ব্যাপারে কারও কোনো ধারণা নেই।

টাকা টাকা টাকা। টাকা ছাড়াও, স্বার্থ ছাড়াও যে কিছু কিছু মানুষ অন্যের ভালোর জন্য কাজ করে -- তা কে কাকে বোঝাবে! এই টাকা কেন্দ্রিক সমাজ তা বুঝবে না। তাই অকথ্য গালি আর বদনাম মাথায় নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করি। মাথার ওপর ছাদ নেই, পায়ের তলায় মাটি নেই জেনেই করি। যে কোনও সময় বাড়ির মালক বলবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে, যে কোনো সময় দেশের শাসক বলবে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে। এসব কিছুই নতুন নয় আমার জন্য।

পাশ্চাত্যের কিছু দেশ আমার সংগ্রামের কথা জেনে আমার দেখভাল করতে চেয়েছিল, আমি সযতনে প্রত্যাখ্যান করেছি তাদের করুণা। বলে দিয়েছি, আমাকে নয়, সাহায্য করতে হলে আমার চেয়েও বেশি যারা অভাবে আছে, আমার চেয়ে বেশি যারা নির্যাতিত তাদের করুন। আমার প্রত্যাখ্যান অবিশ্বাস্য ঠেকবে সবার কাছে। অবিশ্বাস্য কিছু কাজ আমি হেলায় ফেলায় করেছি বটে জীবনে।

আরও পড়ুন: স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপ দিল স্বামী

যে হাতে গোনা ক’জন মানুষ আমাকে জানে, তারা জানে আমি খুব বোকা। আমিও জানি আমি খুব বোকা। না, এ কারণে আমার কোনো আফসোস নেই।

news24bd.tv তৌহিদ

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর