মেয়েটা ফিরেছে মৃত লাশ হয়ে

মেয়েটা ফিরেছে মৃত লাশ হয়ে

আমিনুল ইসলাম

গিয়েছিল সৌদি আরবে। ১৫ বছরের মেয়েকে ২৫ বছর দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।   সেখানে গিয়ে তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটা তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে। তাও ভাগ্য ভালো, তার মৃতদেহ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এরপর তার পরিবার দাবি করেছে- মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হোক। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিরা সেটা হতে দেন'নি!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন- মেয়েটা যে দেশে জন্মেছিল; যে দেশে তারা বাবা-মা'ও জন্মেছিল; যে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য এই মেয়েটার মতো লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়; সেই দেশের সরকারি কর্তারা সোজা বলে দিয়েছে- ময়নাতদন্ত করা সম্ভব না।

সৌদি সরকার বলেছে- মেয়েটা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। এটাই শেষ কথা।

কেউ কী আমাকে বলবেন- সৌদি ফেরত মৃত সকল মেয়ে গুলোই কেন স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছে?

মেয়েটার প্রকৃত বয়েস ছিল ১৫, তার বয়স কী করে ২৫ করা হলো? কে বা কারা এর সাথে জড়িত ছিল?

ঠিক আছে, মেনে নিলাম ১৫ বছর বয়েসেই গিয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাকে কোনো পরিস্থিতি'র মাঝ দিয়ে যেতে হবে, সেটা কী এই মেয়েটাকে কিংবা এমন অন্য সবাই যারা যায়, তাদেরকে শেখানো হয়?

ধরে নিলাম, সৌদি রাজা-মহা রাজারা এই মেয়েটার উপর কোনো পাশবিক নির্যাতন করেনি।

কিন্তু সেখানকার সংস্কৃতি? সেখানকার খাদ্য অভ্যাস? সেখানকার মানুষের ভাষা এইসব সম্পর্কে কী কোনো ধারণা এই মেয়েটার ছিল?

এইসব মেয়েরা তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের বাসা-বাড়িতে কাজ করতে যায়।

আমি চিন্তা করছিলাম আমার নিজের কথা। আজ থেকে ১৮ বছর আগে যখন ইউরোপে পড়তে আসি; শিক্ষিত এই আমাকে'ই তো নানান রকম অজানা বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

সুইডেনে পা দিয়ে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হচ্ছিলাম, দেখি গাড়ি আসছে। থেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি; দেখি গাড়িও থেমে গিয়েছে! আমি পার হচ্ছি না দেখে ড্রাইভার নেমে এসে আমাকে বলেছে।

- তুমি মনে হয় নতুন এসছ এই দেশে। আমাদের এখানে মানুষ আগে। এই ক্রসিং এ তোমাকে রেখে যদি আমি চলে যাই, পরের ক্রসিং এ আমার জরিমানা হয়ে যাবে। তুমি দয়া করে পার হও!

তো, বাংলাদেশ থেকে আসা এই আমি সেটা কী করে জানব!

ছাত্র হোস্টেলে থাকা শুরু করেছি, দেখি কাপড় ধোঁয়ার জন্য লন্ড্রি'র বুকিং দিতে হয় অন লাইনে! আজ থেকে ১৮ বছর আগের কথা বলছি! আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না- এটা কী করে সম্ভব! অন্য আরেকজনের কাছ থেকে শিখতে হয়েছে কীভাবে বুকিং দিতে হয়।

শুধু বুকিং দিলেই তো আর সব শেষ না। আমাদের ঢাকার বাসায় ওয়াসিং মেশিন এসছে আজ থেকে ৮-১০ বছর আগে। এর আগে তো ওয়াসিং মেশিন ছিল না।

তো ১৮ বছর আগের এই আমি কী করে জানব ওয়াসিং মেশিন কী করে চালায়? সেটাও শিখতে হয়েছে। শিখতে হয়েছে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে কী করে ঘর পরিষ্কার করতে হয়।

রান্না করতে গিয়ে দেখি- চুলা হচ্ছে স্বচ্ছ কাঁচ! দেখেই ভাবলাম- এটা কী করে সম্ভব! এই চুলা দিয়ে কী করে রান্না করব! আজীবন তো গ্যাসের তিন কোনা চুলা দেখেই অভ্যস্ত! এরপর জানতে পারলাম- এইসব হচ্ছে ইলেকট্রিক চুলা। স্রেফ বাটন চেপে ঘাট ঠিক করে দিলেই চুলা গরম হয়ে যায়! 

ঘরের কাজের এইসব তো গেল। আমাকে অন্তত কোন সুইডিশ কিংবা বিদেশির সাথে থাকতে হয়নি। আমি ছিলাম আমার মতো ছাত্র হোস্টেলে। তাই নিজের মতো করে থাকতে পারতাম। খাওয়া দাওয়াও নিজের মতো করে করতে পারতাম।  

আমার মনে আছে আমার এক সুইডিশ বন্ধু তার বাসায় আমাকে দাওাত দিয়েছে। তার মা মনের আনন্দে আমার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছে। সন্ধ্যায় ওদের বাসায় গেলাম। খেতে গিয়ে দেখি এমন সব খাদ্য যে গলা দিয়ে আর নামছেই না। আলু সেদ্ধ, তাও কোন রকম লবন-মরিচ ছাড়া। স্যামন মাছ মনে হচ্ছে অর্ধেক সেদ্ধ করে রেখেছে (তখন আমি মাছ খেতাম), মুখেই দেয়ার উপায় নেই! চিংড়ি মাছ মনে হলো, পুরোই কাঁচা! তো, এইসব খাওয়া দেখে তো আমার বমি আসার জোগাড়! এরপরও অনেক কষ্টে ভাব করেছি- খুব'ই চমৎকার হয়েছে।  

এখন আপনি'ই চিন্তা করুন, একটা লেখাপড়া না জানা ১৫ থেকে ২০ বছরের মেয়ে যখন সৌদি আরবে কারো বাসায় কাজ করতে যায়, তাকে তো আমার চাইতে আরও বেশি নানান সব অজানা বিষয়ের মাঝ দিয়ে যেতে হয়।  

প্রতিদিন তাকে যে খাবার দেয়া হয়, সেটা তো সৌদিদের খাবার। তার জন্য নিশ্চয় আলাদা কোন খাবার রান্না করা হয় না। এখন এই মেয়ে কি এই খাবারে অভ্যস্ত? তাকে কি আগে থেকে এই বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে? কিংবা উপরে আমি যেসব অভিজ্ঞতার কথা বললাম? 

এদেরকে নাকি এক মাসের না কয় মাসের ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু সেই ট্রেনিং এ নাকি কিছুই শেখানো হয় না।  

তাহলে এই মানুষ গুলো সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশে, একটা বিদেশি পরিবারের সাথে কি করে থাকবে? এর সাথে যুক্ত করে নিন পাশবিক নির্যাতনের ব্যাপার।  

এই যখন অবস্থা। এইসব বিষয় নিয়ে যখন ভাবার কথা; তখন আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে- বিদেশে থাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশন (মানে দুতাবাস গুলোতে) কিভাবে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে কাজ হয় সেটা দেখার জন্য আমেরিকা-ইংল্যান্ড সহ ৯টি দেশে তারা সফরে যেতে চান! 

এই হচ্ছে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অবস্থা।

আরও পড়ুন: সরিষাবাড়ীর যমুনা নদী থেকে দুজন ভূয়াপুর থেকে একজনের লাশ উদ্ধার

যেই মানুষ গুলো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, মৃত লাশ হয়ে ফিরে দেশের অর্থনীতি সচল রাখাছে; সেই মানুষ গুলো মরে যাবার পর- কেন মারা গেল, সেটা জানার জন্য ময়না তদন্ত পর্যন্ত করা যায় না। আর এই মানুষ গুলোর পাঠানো টাকায় যেই দেশ চলছে; সেই দেশের সরকারি কর্তা'রা, বিসিএস ক্যাডার'রা ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে কিংবা নানান সময় বিদেশ ভ্রমণ করে ; লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়ে ক্যানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়ে সেখানে বউ-বাচ্চা রেখে আসে।  

হ্যাঁ, এরপরও এরাই নাকি দিন শেষে দেশ প্রেমিক বিসিএস ক্যাডার কিংবা সরকারি আমলা!

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর