হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব: প্রিয় ছোটলু ভাই

আলী যাকের

হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব: প্রিয় ছোটলু ভাই

অনলাইন ডেস্ক

আগে পরে অনেক ভেবেছি এই মানুষটা এত অন্যরকম কেন, এত ভালো কেন। চৌকস,মুক্ত চিন্তার সারল্যভরা মানুষটি কেন এত মৃত্তিকার কাছাকাছি। এত মানবিক কেন ভাইটি আমাদের। কোথায় পেয়েছেন এত উচ্ছ্বলতা, এত মেধা, তত বিনয়।

 

বেইলী রোডে পাশে পুকুর পারের নওরতন কলোনীতে তাঁর অফিস রুমে সালাম দিয়ে ঢুকতে ইশারায় বসতে বললেন। বেতার তরঙ্গে শব্দ আসে যায় সেই অবস্থায় তিনি তখন একটা কিছু শুনছিলেন। সালটা ১৯৮৬ হবে হয়তো। ফোর ফোর বলে থামলেন।

 তুমি কি ক্রিকেট ফলো করো। বললাম না। তিনদিন ধরে খেলা চলছে আর সেই খেলার ধারাবিবরণী রেডিওতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি শুনে চলেছেন তেমনটা জানলাম।

ভাবি, সেই সময়ে বাংলাদেশে এতটা ক্রিকেট পাগল ক'জন ছিলেন। আমার জানা নেই। তবে আতা ভাই আর ছোটলু ভাই একত্রে হলেই রিচার্ড কত করেছে আর কপিল কি করলো সেই আলোচনা করতে শুনেছি অনেকবার। সাকুল্যে এই দুজন।  

পরে ছোটলু ভাই সম্পর্কে অনেক জেনেছি। কাছ থেকে দেখেছি তাঁর কত বিস্ময়কর প্রতিভা। ষাট এর দশকে ক্রিকেট খেলতেন ইষ্ট এন্ড এর হয়ে সেটাও জেনেছি। ওপেনিং করতেন আরেক প্রতিভাধর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব  সৈয়দ হাসান ইমাম এর সাথে।


আরও পড়ুন: তুই লুটেরা


এতো গেল ক্রিকেট। ক্যামেরায় কতকিছুর কত শত ছবি যে তুলতেন যখন ডিজিটাল যুগ ছিল না তখনই। আর অনেক পরে এই ডিজিটাল যুগে ফেইসবুকের কল্যাণে তাঁর তোলা কত কত অসাধারণ সব আলোকচিত্র দেখেছি নিয়মিত। কানাডা প্রবাসী হবার তাঁর সাথে কথা হয়ে অল্পবিস্তর অন্তর্জালে।  

অনলাইনেই দেখেছি সিংগাপুরের হাসপাতালের জানালার ধারের এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় জলের উপর তাঁর বাড়ির আশপাশের ছবি। কখনো পাখি, কখনো প্রকৃতি মা।

গত নভেম্বর ৬ ছিলো তাঁর জন্মদিন। অসংখ্য গুনগ্রাহীর মতো আমিও তাঁকে জানিয়েছি শুভ জন্মদিন। তিনি জন্মেছেন ১৯৪৪ সালে আর এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে গেলেন এই নভেম্বর ২৭, ২০২০। আত্মপ্রত্যয়ী যোদ্ধা ছোটলু ভাই দীর্ঘদিন কর্কট রোগে ভুগছিলেন।

ছোটলু ভাইয়ের বাবা ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। নটরডেম কলেজ এইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময় তাঁর বাবা মোহাম্মদ তাহের হৃদরোগে মারা যান। সেই সময়ে অর্থনৈতিক চাপের মুখে, নিজেকে গড়ার লক্ষ্যে, স্বাবলম্বী হবার দৃঢ় বাসনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞানে ছাত্রাবস্থায় আমেরিকান ইলাই লিলি ফার্মাস্টিক্যাল কোম্পানিতে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের চাকরি নেন তিনি।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেই যখন তাঁর মাত্র ২২ বছর বয়স তখন তিনি ঢুকে যান বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিতে। দুই বছর না যেতে মাত্র ২৪ বছর বয়সে হয়ে যান তৎকালীন ইষ্ট এশিয়াটিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার পুবের প্রধান। সংস্থার প্রধান হিসেবে তাঁকে গাড়ি, এপার্টমেন্ট দেয়া হয়েছিল কিন্তু ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের নামে রাজারবাগ এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ দেখে, দাউ দাউ আগুনের লেলিহান দেখে সব ছেড়ে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। যাবার আগে অফিসের কেন্দ্রীয় প্রধানকে চিঠি লেখেন " The country calls me and i have got to response. This call is much bigger than the call of my corporation."

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনি শব্দ সৈনিক ছিলেন। স্বনামেই ইংরেজি খবর পাঠ করতেন নিয়মিত। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার অনুষ্ঠানে ধারাবর্ননাও করতেন তিনি ।

ছোটলু ভাইয়ের ভালবাসায় সিক্ত ছিলাম। এত স্নেহ এত আদর নাট্য অঙ্গনের খুব কম মানুষের কাছে পেয়েছি। ঈশাত আরা মেরুনাকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ছিলেনমেরুনার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক। ফেইসবুকে মেরুনার লেখা মতামত দিতেন নিয়মিত, উৎসাহ দিতেন সব সময়।

৮০ দশকের ছোটলু ভাইয়ের  অভিনীত প্রায় সব মঞ্চ নাটক দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সান্নিধ্য পেয়েছি একটি নাটকের এক্কেবারে মহড়ার প্রথমদিন থেকে শেষ পর্যন্ত। সেবার ব্রিটিশ নাট্যনির্দেশক ডেবোরা ওয়ার্নার এর নির্দেশনায় সৈয়দ শামসুল হক অনুদিত উইলিয়াম শেক্সপীয়ারে " টেম্পেস্ট" অনেকের সাথে আমিও ছিলাম একজন নেপথ্যে কর্মী।

তখন মহড়ায় দেখেছি ছোটলু ভাইয়ের অভিনয়ে ডোবরা ইয়েস, ইয়েস-ই অনেক করতেন। খুব কাছে থেকে দেখেছি ক্যালিবান আর প্রসপেরোর দৃশ্য, এরিয়াল এর সাথে দৃশ্য কি নিঁখুতভাবেই না ছোটলু ভাই কত সহজে অল্পদিনেই আত্মস্থ করেছেন, মুখস্থ বলে গেছেন লাইনের পর লাইন, নিজেকে প্রস্তুত করেছেন যেমনটা নির্দেশক চেয়েছেন।

নিজের বেলায় বলতে পারি ঠিক নেপথ্যে না মঞ্চেও ছিলাম। মিরেন্ডার ঝড় দেখার প্রথম দৃশ্যে আমিও ছিলাম মঞ্চে, অন্ধকারে। ডেবোরা এমন ডিজাইন করেছিল যে মিরেন্ডা চরিত্রের শান্তা ইসলাম আমার স্কন্ধে দাঁড়িয়ে ঝড় দেখে আর সংলাপ বলে।

ঢাকার মহিলা সমিতির মঞ্চে যখন প্রথম নূরলদীনের সারাজীবন দেখি সেদিন অপার বিস্ময় জেগেছিল ছোটলু ভাইয়ের অভিনয় দেখে। কী সেই উদাত্ত কন্ঠ, কী বিপ্লবী ডাক " জাগো বাহে কোনঠে সবাই "। "কাঁই কইলে নাই না, কাঁই কইলে নাই। নূরলদীন কি সামনে তোমার নাই। ' 

সংলাপ প্রক্ষেপণে নবরসের  চূড়ান্ত মুন্সিয়ানার দেখিয়েছেন তাঁর প্রতিটি অভিনীত নাটকে। তিনি দুর্দান্ত অনন্য যেমন ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, গ্যালিলিওতে তেমনি অসাধারণ দেওয়ান গাজী,  নূরলদীনে সারাজীবন নাটকে। গ্যালিলিও নাটকের মহড়া দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যুবরাজ আর ছোটলু ভাইয়ের আহা সেকি অভিনয়।   নাটকটি কয়েকবার দেখেছি জার্মান কালচারাল সেন্টারে। কতবার বলেছি " অভাগা সে দেশ যার বীরপুত্র নেই কিংবা অভাগা সেই দেশ যার বীরপুত্রের প্রয়োজন "।

নাটকের অন্তপ্রাণ আলী যাকের বাদল সরকারের বাকী ইতিহাস নাটক নির্দেশনা দিয়ে নাট্যজন জিয়া হায়দার, আতাউর রহমান, আবুল হায়াত প্রমুখ এর সাথে নিয়ে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নামে দর্শনীর বিনিময়ে ঢাকার মঞ্চে নাটক শুরু করেন।  

এর আগে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় শুধু রেডিও টিভিতে কয়েকটি নাটক করে। আলী যাকের প্রথমে মামুনুর রশীদ এর নির্দেশনায় আরন্যক নাট্যদলের হয়ে মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে অভিনয় দিয়ে মঞ্চে অভিনয় জীবন শুরু করেন। আর দুই বছর আগেও তিনি গ্যালিলিও নাটকে অভিনয় করেন ৭৪ বছর বয়সে।

জন্মিলে মরিতে হবে এ তো ধ্রুব সত্য। তবে আলী যাকের এর মতো অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধকামী, মানবিক- সামাজিক, বিদ্বান বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব সহসা আর আসবে কি এই বাংলায়।   একে একে নিভে যাচ্ছে দেউটি। চলে যাচ্ছেন আমাদের যাঁকে যাঁকে প্রয়োজন। আমরা হারালাম আমাদের বাতিঘর, শিল্পের নক্ষত্র।

" ভালো করি একবার দেখি নিয়া ভাই
কও দেখি, তোমার নূরলদীন নাই, সত্য নাই?...

হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই। "

আহমেদ হোসেন, টরন্টো

news24bd.tv নাজিম