পোল্যান্ডে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ, আক্রান্ত হচ্ছেন বহু বাংলাদেশি!

পোল্যান্ডে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ, আক্রান্ত হচ্ছেন বহু বাংলাদেশি!

রাকিব হাসান রাফি

পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ১,২০,৭৩৩ বর্গমাইল আয়তনের দেশ পোল্যান্ড। আয়তনের দিক থেকে দেশটি গোটা ইউরোপে নবম বৃহত্তম রাষ্ট্র। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় চার কোটির মতো মানুষ বসবাস করেন।

ওয়ারশ পোল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী।

পোল্যান্ডের জাতীয় মুদ্রার নাম জোলিটি। পশ্চিমে জার্মানি, দক্ষিণে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া, পূর্বে ইউক্রেন ও বেলারুশ উত্তরে বাল্টিক সাগর, লিথুয়ানিয়া ও রাশিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত এ দেশটি একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবেও সমাদৃত। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে জাগিয়েলনীয় রাজবংশের তত্ত্বাবধায়নে পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যতম এক পরাশক্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে ভৌগলিক অবস্থান এবং সমৃদ্ধশালী ইতিহাসের জন্য দেশটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসকদের দ্বারা আগ্রাসনের শিকার হয়।

এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে। আবার নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পোল্যান্ড সর্বপ্রথম রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয় থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয় এবং কার্যতভাবে পোল্যান্ডের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুরু হয়। মেরি মাদাম কুরী, খ্রিস্টান ধর্মগুরু জন পল, নিকোলাস কোপার্নিকাস, অ্যাডাম মিকিউইকজ, ফ্রেদেরিক শোপা থেকে শুরু করে বিশ্ববরেণ্য অনেক ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছিলো পোল্যান্ডে। ১৯৯৯ সালে পোল্যান্ড ন্যাটো এবং ২০০৪ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। ওয়ারশ, ক্র্যাকো, জিদান্স্ক, পোজনান, রাক্লোসহ পোল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের ওল্ড টাউনগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রত্যেক বছর হাজারো পর্যটকের সমাগম হয় দেশটিতে।


আরও পড়ুন: বিশ্বের ব্যয়বহুল ১০ শহর


ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে পোল্যান্ডে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম। এমনকি দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনেক কম খরচে পড়াশুনা করা যায়। এ কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে পোল্যান্ড উচ্চশিক্ষার জন্য এক পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এছাড়াও বিনিয়োগবান্ধব অভিবাসন নীতির কারণে ব্যবসায়িক সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকে অভিবাসী হিসেবে পোল্যান্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন। এক সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পোল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা মিলতো অনেক সহজে। বাংলাদেশ থেকেও কাজের ভিসায় অনেকে পোল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছেন।  

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্য কোনও দেশের ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট নিয়েও পোল্যান্ডে এসে অনেকে ওয়ার্ক পারমিটের মাধ্যমে সে দেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছন যদিও বর্তমানে দেশটির সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কারণে এ ধরণের সুযোগ অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

করোনার ভয়াল থাবা থেকেও নিষ্কৃতি পায় নি  ইউরোপের এ দেশটি। গত চার মার্চ পোল্যান্ডের জিয়েলোনা গোরাতে জার্মানি ফেরত ৬৬ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে ফার্স্ট ওয়েভে অর্থাৎ মার্চ থেকে শুরু করে জুন এ চার মাসে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে আমরা করোনার প্রভাবে যেখানে হাজারো মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখেছি সেখানে ফার্স্ট ওয়েভে পোল্যান্ডে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিংবা করোনার প্রভাবে মৃত্যুবরণকারী রোগীর সংখ্যা ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

সেকেন্ড ওয়েভে এসে দেশটির পরিস্থিতি একেবারে উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে। বর্তমানে সংক্রমণের হার বিবেচনায় পোল্যান্ডকে ইউরোপের অন্যতম হটস্পট বললেও ভুল হবে না। ওয়ার্ল্ড ও মিটার্স ডট ইনফো কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পোল্যান্ডে সর্বমোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯,৮৫,০৭৫ জন।

এছাড়াও প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের এ দেশটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৭,০২৯ জন এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৫,৫৯,৪২৯ জন। গড়ে প্রতিদিন দেশটিতে পনেরো হাজারের বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং পাঁচশোর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন।

অথচ ফার্স্ট ওয়েভে অর্থাৎ মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত সময়ে দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছিলো ৩৪,০০০ এর কিছু বেশি। বলাবাহুল্য শীতের আগমনের সাথে সাথে পোল্যান্ডে সেকেন্ড ওয়েভে আশঙ্কাজনকভাবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গ্রীষ্মকালীন সময়ে অবকাশ যাপনের কেন্দ্রগুলোতে এক সাথে অধিক মানুষের সমাগম ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে দেশটির জনসাধারণের অসচেতনতা মূলত সেকেন্ড ওয়েভে দেশটি করোনা সংক্রমণ বিস্তারের প্রধান কারণ।

আরও পড়ুন: ক্রোম ব্রাউজারের যত হিডেন ফিচার

সঠিকভাবে উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও পোল্যান্ডে সব মিলিয়ে তিন থেকে চার হাজার বাংলাদেশির বসবাস, যাদের বেশিরভাগই পোল্যান্ডে এসেছেন শিক্ষার্থী হিসেবে যদিও শেষ পর্যন্ত অনেকে পড়াশুনা শেষ না করে ওয়ার্ক পারমিটের মাধ্যমে তাদের ভিসার প্রকৃতি পরিবর্তন করেছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্য কোনও দেশের ভিসা বিশেষত স্টুডেন্ট ভিসা কিংবা টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট নিয়েও পোল্যান্ডে এসে ওয়ার্ক পারমিটের মাধ্যমে অনেক বাংলাদেশি সে দেশে থেকে গিয়েছেন।

ব্যবসায়িক সূত্রেও অনেকে বাংলাদেশ থেকে পোল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এক সময় পোল্যান্ডে অনেক সহজে রেস্টুরেন্ট কিংবা কাবাব শপ চালু করা যেতো। পোল্যান্ডে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সাথে জড়িত। এদের মাঝে কেউ কেউ রেস্টুরেন্ট কিংবা কাবাব শপের মালিক, কেউ আবার এ সকল রেস্টুরেন্ট কিংবা কাবাবশপে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। ওয়ারশ, রক্লো এবং পোজনান পোল্যান্ডের এ তিনটি শহরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। রাজধানী ওয়ারশতে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাসও রয়েছে।   

পোল্যান্ডে অবস্থিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শদাতা এডুএক্সপ্লোরের সিইও প্রকৌশলী আহমেদ রাজ বিন আইয়ুবের সাথে কথা বলে জানা গেলো যে দেশটিতে সেকেন্ড ওয়েভে অনেক বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমনকি কয়েক দিন পূর্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশটির অন্যতম শহর রাক্লোতে চল্লিশোর্ধ্ব এক বাংলাদেশির মৃত্যুও হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। রাজ নিজেও করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন।

তিনি বলেন,অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে তিনি তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। কয়েক দিন পর তিনি লক্ষ্য যে তিনি খাবারে আগের মতো স্বাদ অনুভব করছেন না এবং এক পর্যায়ে তাঁর শরীরে জ্বরের উপসর্গ দেখা যায়। তিনি কোভিড-১৯ টেস্ট করান এবং ফলাফল পজিটিভ আসে। তাঁর সাথে থাকা আরও দুই বাংলাদেশিও একই সময়ে করোনা ভাইরাসে আকান্ত হয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। যদিও প্রায় এক মাস অসুস্থ্য থাকার পর তিনি কয়েক দিন পূর্বে সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন তবে করোনা পরবর্তী বিভিন্ন জটিলতা এখনও তাকে ভুগাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশটিতে বসবাস করা আরও এক বাংলাদেশি জানান সেকেন্ড ওয়েভে এসেও দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝে করোনা নিয়ে তেমন একটা সচেতনতা কাজ করছে না। অনেকের শরীরে করোনার উপসর্গ থাকার পরেও তারা বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন না, এমনকি নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়েও করোনার টেস্ট করাচ্ছেন না বলে তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন। সেকেন্ড ওয়েভে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশটির সরকার সকল বার রেস্টুরেন্ট ও কফিশপ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনও রেস্টুরেন্ট চাইলে পার্সেল খাবার বিক্রি করতে পারবে। এ সুযোগে অনেক বাংলাদেশির শরীরে করোনা উপসর্গ থাকার পরও তারা যথার্থ চিকিৎসা গ্রহণ না করে রেস্টুরেন্ট কিংবা কাবাবের শপগুলোতে ছুটে যাচ্ছেন কাজের জন্য।

সবশেষে তিনি জানান একদিকে যেমনিভাবে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল ইউরোপের এ সকল দেশের মতো পোল্যান্ডের বাংলাদেশ কমিউনিটি খুব একটা শক্তিশালী না হওয়ায় এ রকম পরিস্থিতিতে কেউ চাইলেও অন্যের সাথে সেভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন না;  অন্যদিকে দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইউরোপের এ সকল দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মতো তেমন একটা সুদৃঢ় অবস্থান না থাকায় একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। তাই এ অবস্থায় তিনি করোনার এ দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশটির সকল বাংলাদেশিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পাশপাশি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য আহবান জানিয়েছেন এবং একই সাথে পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ পরিস্থিতিতে দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে থেকে কার্যকরি সহায়তা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

news24bd.tv নাজিম