‘আমি এই মামলাতেই মরে গেছি’

‘আমি এই মামলাতেই মরে গেছি’

আব্দুল লতিফ লিটু, ঠাকুরগাঁও

বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাস সবার কাছে  "গলেয়া দাস" হিসাবে পরিচিত।  ১৯৫১ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের দেবীগঞ্জ বাজারে জন্ম তাঁর।  মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

বর্তমানে তার বয়স ৭১।

জন্মের পরে বাবাকে হারিয়ে, অসুস্থ মা ও প্রতিবন্ধী বড় ভাইকে নিয়ে অভাবের সংসারে, এক বেলা খেয়েই কোন মতো দিন পার করতেন। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মাকেও হারিয়েছেন।  অন্যের বাসা-বাড়িতে রাখালের কাজ করে একবেলার আহার জোগাড় করে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিবন্ধী বড় ভাইকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমানের সাথে চলে যান ভারতের থুকরাবাড়ি ক্যাম্পে।

সেখানে প্রথমে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব ক্যাম্পে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে চলে যান মুক্তিযুদ্ধের ৬ নং সেক্টর চেংরা মাড়া টাউনের বুড়ি মাড়ি হাটে সেখানেই উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের অধিনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।

news24bd.tv

দেশ স্বাধীনের পর দেবীগঞ্জ বাজারের একটি ছোট্ট সাইকেল মেরামতের দোকান দেন। দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জনক তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে দিলেও বড় মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় সে এখন বাবার বাড়িতেই থাকছেন।

আর বড় ছেলে বাস-রেলস্টোশনে কুলির কাজ করে সংসার চালান। ছোট ছেলে ডিগ্রী পাস করে চাকরির জন্য দফতরে দফতরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এখন ক্ষেত খামারে কাজ করেন। আর তিনি রাস্তার ধারে বসে বাইসাইকেল মেরামতের কাজ করেন।

বীর মুক্তিযদ্ধা রমেশ চন্দ্র বেশির ভাগ সময় থাকেন মুখ ভরা হাসি নিয়ে। স্থানীয়দের কাছে মানুষ হিসেবে অত্যন্ত রসিক এবং খোলা মনের, কারো কাছে তাঁর কোন চাওয়া কিংবা কারো প্রতি রাগ-অনুরাগ নেই তার। শুধু আছে অন্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সম্মান, বিশ্বাস, দেশপ্রেম, আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

জানাযায়, দীর্ঘ ৩০ বছর অপেক্ষার পর বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া শুরু করলে তিনিও সেই ভাতা পান। প্রথম দিকে ৩০০ থেকে এখন ১২ হাজার টাকা মাসিক মুক্তিযদ্ধা ভাতা উত্তোলন করেন। এবং বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসাবে একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

news24bd.tv

আরও জানা যায়,  স্থানীয় শহীদুল রহমানের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জমি সংক্রান্ত বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলা চালাতে দীর্ঘ ১৮ বছর আদালত পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে ঋণের দায়ে তিনি আজ সর্বশান্ত।  

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মণের কাছে গেলেও কোন প্রতিকার না পেয়ে বরং উল্টো কথা শুনে অসহায়ের মতো ছল ছল চোখে ফিরে আসেন। অবশেষে চলতি বছরে সেই মিথ্যা মামলা রায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাসের পক্ষে আসে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ বলেন, মিথ্যা মামলার জন্য আমাকে ১৮ বছর কোর্টের বারান্দায় ঘুরাঘুরি করছি। ১৮ বছর খেয়ে না খেয়ে ঋণ করে মিথ্যা মামলা চালিয়েছি। আমার ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে এই বয়সেও সাইকেল মেরামত করে এতো বড়ো সংসার চালাতে হচ্ছে। কি আর বলব বলুন?


আরও পড়ুন: বিশ্ববাসীকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান ইরানের


কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, আমার দুই চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ছোট ছেলেকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা শিখালাম যদি একটা চাকরি পায়। আমার টাকা নাই তাই চাকরিও নাই। তাই রাস্তায় বসে সাইকেল মেরামত করে মহাজনের ঋণ শোধ করতেছি। যত দিনবেঁচে থাকবো মেকারি করে এই ঋণ শোধ করব। কিন্তু আমি এই মামলাতেই মরে গেছি।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যদি আমাকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ও একটা ঘর নির্মাণ করে না দিতো তাহলে আজ আমাকে বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমি খুবই খুশি। ভগবান যেন তাঁর দীর্ঘায়ু দেন, তাকে সব সময় সুস্থ রাখুক ভগবানের কাছে এটাই আমার আবেদন।

তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আমার একটা অনুরোধ আমি তো রাস্তায় বসে মেকারি করি। আমি আর কয়দিন বাঁচব। আমার একটা আবেদন প্রধানমত্রীর কাছে আমার ছেলে গোতম চন্দ্র দাসের যেন একটা চাকরি দেয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। আমার ছেলেকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।

news24bd.tv নাজিম