'‌‍কিছু মানুষ কখনোই তার নিজের রূপে ফিরতে পারে না'

'‌‍কিছু মানুষ কখনোই তার নিজের রূপে ফিরতে পারে না'

আমিনুল ইসলাম

ঘুম আসছিল না। বিছানা ছেড়ে কফি মেশিনে কফি বানিয়ে গ্লাস হাতে হাঁটতে বের হয়েছি।  

মাঝরাত পার হয়েছে অনেক আগেই। ছোট্ট মায়াবী এই শহরটা এখন ঘুমাচ্ছে।

আমি সদর দরজা পার হয়ে রাস্তায় নেমে এসছি। মৃদু বাতাস বইছে এখন। ডিসেম্বরের শুরু। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে নেমে গিয়েছে।

ডানদিকের রাস্তা ধরে হাঁটছি। চারদিকে শুনশান নিরবতা। কোথাও কোনো মানুষ নেই। পাতাবিহীন পাইন গাছটা অবশ্য বাতাসে নড়ছে। চমৎকার শব্দ হচ্ছে। খানিক এগুতে'ই পাশের আইরিশ পাব।

পাবে কাজ করা মেয়েটা বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ভেতর থেকে নানান বয়সি মানুষের শব্দ ভেসে আসছে। পাব পার হয়ে বাম দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে'ই চমৎকার করে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি চোখে পড়ল। মনে হচ্ছে একা'ই দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়।

ক্রিসমাস ট্রি পার হয়ে মূল রাস্তায় উঠবো, এমন সময় মনে হলো বাতাসের গতি খানিক বেড়েছে। পাশেই বালটিক সমুদ্র থাকাতে মনে হয় বাতাসের গতি বাড়ছে। মিনিট দশেকের হাঁটার পথ। ভাবছিলাম, যাই এই মাঝ রাতে গিয়ে সমুদ্র পাড়ে খানিক একাকী হেঁটে আসি।

মূল রাস্তা ধরে নির্জন রাস্তায় হাঁটছি। কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই; এমন সময় দেখি রাস্তার ডান পাশে মানুষজন বসার যে'ই বেঞ্চ থাকে; সেখানে মাঝ বয়েসি এক মেয়ে বসে আছে। এতো রাতে এই মেয়ে নির্জন রাস্তায় একা বসে আছে কেন? কোথাও কোনো গাড়ি চলার শব্দও তো শোনা যাচ্ছে না।

খানিক এগুতে'ই দেখি ইনগ্রিদ। আমার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে'ই থাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, মেয়েটা নাম ধরে ডাকছে 

- তুমি আমিনুল না? এতো রাতে একা একা হাঁটছ কেন?
-হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আমি আমিনুল। কিন্তু তুমি এতো রাতে এখানে কী করছ?

আরেকটু কাছে যেতেই মেয়েটার মুখ পরিষ্কার বোঝা গেল। এমনিতে সব সময় বেশ পরিপাটি'ই তো দেখি মেয়েটাকে। আজ মনে হচ্ছে চুলগুলো অগোছালো। শীতের জামাটাও ঠিক মতো পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম 

-এতো রাতে একাকী এখানে? 
-ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ একা রাস্তার পাশে বসে থাকি।
- কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমার?
-না, তেমন কিছু না। আমার কুকুর'টা খুব অসুস্থ। ওকে সন্ধ্যে বেলা হাসপাতালে রেখে এসছি। খুব খারাপ লাগছে।  

আমি মেয়েটার দিকে আবার তাকালাম। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে- বাসার একটা সদস্য হাসপাতালে থাকাতে ওর হয়ত খারাপ লাগছে। এই জন্য এই মাঝ রাতে একাকী বসে আছে।

- চিন্তা করো না। ও নিশ্চয় ভালো হয়ে আবার ফেরত আসব।
- ধন্যবাদ তোমাকে।

আমি মেয়েটাকে বিদায় জানিয়ে সমুদ্রের দিকে হাঁটছি। রাস্তার পাশে দেয়ালের ঠিক গা ঘেঁষে লেগে থাকা বড় ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ বেজে উঠে জানান দিচ্ছে মাঝ রাত পার হয়েছে অনেক আগেই। হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন এসে ভর করেছে

- আচ্ছা, ইনগ্রিদ নামের এই মেয়েটার কি কখনো কোনো মানুষের জন্য এমন খারাপ লেগেছে?

 সেবার যখন প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ। যখন একটু ছায়া'র খুব প্রয়োজন ছিল। যার কাছে নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করেছিলাম। তার কাছে গিয়ে বলেছিলাম

- আমি আমার সুস্থতা ভিক্ষা চাইছি। একটু সময় চাই কেবল।

এই আমাকে'ই তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। স্রেফ নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করার কারণে কুকুর-বেড়ালের মতো আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

সেই আমরা'ই আবার কুকুর-বেড়ালের প্রতি মায়া দেখাই। কখনো কখনো তাদের অনুপস্থিতি'তে আমাদের ঘুম আসে না। অথচ মানুষ হয়ে জন্মেও স্রেফ কিছু অপূর্ণতা'র জন্য কিছু মানুষ এক জীবনেও মানুষের স্বীকৃতি টুকু পায় না।

বাতাসের গতি তীব্র হচ্ছে। বুঝতে পাচ্ছি সমুদ্রের কাছে চলে এসছি। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ অবশ্য শোনা যাচ্ছে না। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে। সমুদ্রে'র পানিও জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

বাতাসে গতি আরও বেড়ে গিয়েছি। শীত প্রবল হচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। আমি দ্রুত পায়ে বাসায় ফিরছি। এমন সময় তুষার পড়া শুরু হয়েছে। শ্বেত শুভ্র তুষার। খানিক আগের শহরটা সম্পূর্ণ অন্য রূপ ধারণ করেছে। এখন আর চেনা'ই যাচ্ছে না। কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে।

আমি দ্রুত পায়ে হাঁটছি আমার এপার্টমেন্টের দিকে। হঠাৎ মনে হলো- তুষারে ঢাকা এই শহর কাল সকালে'ই হয়ত আবার নিজের রূপে ফেরত আসবে। জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাওয়া সমুদ্রও হয়ত এই গ্রীষ্মে আবার নিজের রূপ ধারণ করবে।

স্রেফ কিছু মানুষ কখনোই তার নিজের রুপে ফিরতে পারে না। নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। নইলে যে মানুষ ঘৃণা করবে। অবহেলা করবে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে।

তুষার পড়ার গতি বাড়ছে। আমি দ্রুত পায়ে আমার এপার্টমেন্টের দিকে ফিরছি।

আমিনুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অস্ট্রিয়া। (ফেসবুক থেকে)

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর