স্বাধীনতার মূল্য ভীষণ চড়া

স্বাধীনতার মূল্য ভীষণ চড়া

সাদিয়া নাসরিন

স্বাধীনতার মূল্য ভীষণ চড়া। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শোধ করতে হয়। শুধুমাত্র মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি বলে, দাসের জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেছি বলে, স্বাধীন স্বনির্ভর জীবন কাটাচ্ছি বলে যে মূল্য আমাকে, আমার সন্তানকে, আমার বাবা-মা ভাই-বোনকে দিতে হচ্ছে, হয়েছে, তা পরিমাপ হবে না কোনও বাটখারায়।

মেয়ে হয়ে একটি সেল্ফ ড্রিভেন জীবনের মালিক হয়েছি বলে নিরন্তর অপরাধ বোধে ভুগতে হয়েছে আমাকে।

আমি বাবা-মায়ের বড় সন্তান, অথচ আমি না হতে পেরেছি 'লক্ষী মেয়ে', না হতে পেরেছি তাদের শান্তির নির্ভরতা।

বরং আমি সেই কন্যা, যার বাবা মাকে তার লেখার জন্য কথা শুনতে হয়, টেলিভিশনে ‘ধর্ষণ’ নিয়ে কথা বলার জন্য ‘লজ্জা’ পেতে হয়, দূর-দূরান্ত থেকে অভিযোগ শুনতে হয় শাহবাগে দাঁড়াই বলে, লোকজন বাড়ি বয়ে গিয়ে আমার চরিত্রের পোস্ট মর্টেম করে আসে, আমার মাকে শুনতে হয় সেসব।

আমার লেখার শিরোনাম বিকৃত করে, ভেতরে অশ্লীল কথা জুড়ে দিয়ে, ফেইক স্ক্রীনশট বানিয়ে ভাইরাল করে দিয়ে যখন কপির পর কপি আব্বার কাছে পাঠায়, আব্বাকে সেসব হজম করতে হয়। হজম করতে হয় আমার ভাইদেরকে, তাদের বউদেরকেও।

 
আমার নিরাপত্তার চিন্তায় অনেক দূরে বসে আমার বয়স হয়ে যাওয়া আব্বা-আম্মাকে জায়নামাজে আকুলি-বিকুলি করতে হয়, শুধুমাত্র আমার ঘাড়ের উপরের বেয়াড়া মাথাটা নত হতে শেখেনি বলে।  

প্রতি রাতে গভীর উৎকন্ঠা নিয়ে আব্বাকে আমার টাইমলাইনে ঘুরে দেখতে হয় নতুন কিছু  লিখেছি কিনা যা আমাকে বিপদে ফেলতে পারে, শুধুমাত্র আমি  নিজের কথাগুলো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করি বলে।

আর আমি  আমার পুত্র-কন্যার জন্য একটি উৎকন্ঠাহীন পৃথিবী গড়ব বলে, ‘ভালো মেয়ে’, ‘সংসারি মেয়ে’ ‘ভালো মা’ ‘ভালো স্ত্রী’ হতে না পারার অক্ষমতা ঢেকে রাখতে অকারন ক্রোধে চ্যাঁচাতে থাকি বাবা মায়ের সাথেই। তাদের সেই মূল্যও কিছু মাত্র কম নয়। ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে জন্ম দেয়ার মূল্য অনেক বেশি।

মা হিসেবে তো আরো বিপর্যস্ত অবস্থা আমার। আমাকে চোখের সামনে দেখতে হয়, আমার লড়াইয়ের মূল্য বাচ্চারাও কীভাবে দেয়। বাবার সাথে মায়ের পাওয়ার রিলেশনের নেগোসিয়েশন দেখতে হয় তাদেরকে পক্ষপাতহীন থেকেই। ছোট ছোট বুকের উপর এই চাপগুলো বড় ভারী।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন আমার বা আমার সহযোদ্ধা বন্ধুদের চরিত্রের ময়নাতদন্ত হয়, বাজে মিথ্যাচার হয়, নোংরা ব্যক্তি আক্রমণ হয়, সেইসব ঘটনা বাচ্চাদের কীভাবে ইফেক্ট করে সেটা নিজের চোখে দেখতে হয়।

অনেক দম নিয়ে বসে বাচ্চাদের ব্রিফ করতে হয়, এইসব নোংরা আক্রমণের চাপ যদি তাদের কমিউনিটিতেও এসে তাদের কোনঠাসা করতে চায়, তারা কীভাবে সেগুলোকে ফেইস করবে।

কোনো ইস্যুতে ন্যাশনাল মুভমেন্ট শুরু হলে, সেই মুভমেন্ট নিয়ে কিছু লেখার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় বিবিধ চাপ ও টেনশন। তখন বাচ্চাদেরকে ওরিয়েন্ট করতে হয় খারাপ কিছুর জন্য। মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয় যে ‘কোনো বাহিনীর কেউ’ এসে মাকে নিয়ে গেলে বা মা যদি ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে না আসে, তারা কী করবে, কাকে ফোন করবে, কার কাছে যাবে।

আমি সেই মা, যাকে গত তিনবছরে চারবার বিভিন্ন এজেন্সির সাথে কথা বলতে হয়েছে শুধুমাত্র লেখার ‘অপরাধে’। যেতে হয়েছে বাচ্চাদের বাসায় একলা রেখে অনিশ্চয়তাকে সাথে করে। যাওয়ার সময়, লম্বা শ্বাস টেনে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে বলতে হয়েছে,‘আমার বাচ্চারা কি ভয় পায়?’ বাচ্চারা বুকের ভাঙা শব্দ লুকিয়ে রেখে উঁচু গলায় বলেছে, ‘আমরা সাদিয়ার বাচ্চা না! সাদিয়ার বাচ্চারা ভয় পায়না’।

একই সাথে বাচ্চাদেরকে খুব র‍্যাশনালি বুঝাতে হয়েছে কেন আমাদেরকে এতো বিপদ জেনেও এরকম একটা মুভমেন্ট এর সাথে থাকতে হয়। সেটা তাদের নিরাপদ আগামীর জন্যই।

শুধু আমি নই, আমাদের জীবনটাই এইরকম অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ছায়া হয়ে গেছে এখন।

অথচ আমি, এই আমরা তো শুধু মানুষের মুক্তির কথা বলতে এক হয়েছি, নারীর জন্য মানুষের জীবন চেয়েছি, সমান অধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইটা করছি। যেনো একটি মেয়েকেও নিপীড়ন-নির্যাতন -নিষেধের কাঁটাতার পেরুতে রক্তাক্ত হতে না হয়। যেনো মেয়েরাও পায় নির্বিঘ্ন স্বাধীনতার দীগন্ত জোড়া আকাশ।

আরও পড়ুন: ‘বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলবেন আমরা কি আপনাদের চুমো দেব?’

এই লড়াইয়ের সুফল কিন্তু আমাদের গায়ে ঢিল ছোঁড়া প্রত্যেক নারী-পুরুষের ঘরেই যাবে। যে পুরুষটি এবং নারীটি আমাদের পথে কাঁটা বিছায় প্রতিদিন, তাদের কন্যার স্বাধীনতার জন্যও এই লড়াই।

দিন শেষে এই স্বাধীনতা রক্তের দামে মেলে, যে রক্ত নিরন্তর ঝরে সবার চোখের আড়ালে। যে রক্তের রঙ সাদা। সেই রক্তপথই আমাদের পথ।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর