আপনার উদ্বেগের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না
রোহিঙ্গা ও ভাসানচর প্রসঙ্গ:

আপনার উদ্বেগের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না

মোজ্জাম্মেল হোসেন মঞ্জু

বন্ধুবর সাংবাদিক-কলামিস্ট কামাল আহমেদ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক মহলের উষ্মা প্রসঙ্গে একটি পোস্ট দিয়েছেন। শুরুতে লিখেছেন, “উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যতটা প্রশংসা কুড়ালো, তা এত অল্পতেই জলাঞ্জলি দেওয়ার ঘটনায় কি বাহবা দেওয়া উচিত? না নিন্দা?...” (লিঙ্ক প্রথম মন্তব্যের ঘরে) রিপ্লাই অপশনে লিখতে গিয়ে দেখি অল্প শব্দে বলতে পারছি না। একটু আলোচনা প্রয়োজন। তাই তাঁর রেফারেন্সে পৃথক পোস্ট দিলাম।

 

আমার জবাব: কামাল ভাই, আপনার উদ্বেগের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না।  

১. আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসায় আমাদের পেট ভরবে না। রোহিঙ্গারা কোথায় থাকবে, কী খাবে, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কোথায় হাগবে সে দুশ্চিন্তা না করে তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সাহায্য করা অর্থাৎ চাপ দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কার্যকর এনগেজমেন্টে থাকা। হ্যাঁ, মানবিক সাহায্য আমরা নেব এবং নিতেই হবে।

তবে সংবাদমাধ্যম তদন্ত করে আমাদের জানাক যে, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার কত ডলার ব্যয় করেছে, আর শরণার্থী বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মহল কত দিয়েছে। কক্সবাজারের বন উজাড়সহ পরিবেশ ক্ষয়ের আর্থিক মূল্যও যোগ করতে পারেন।

২. দশ লাখ ও এক লাখ সম্পর্কে বলতে হয়, বালতি যখন ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে তখন এক ঘটি পানি সরানোরও দরকার আছে। কক্সবাজারের স্থানীয় নাগরিকদের চেয়েও শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই প্রকল্প সফল হলে আরও অন্য জায়গায় কিছু কিছু শরণার্থী সরানো যাবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো গেলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয়ের অবকাঠামো কাজে লাগবে না? দ্বীপটা তো জনশূন্য থাকবে না। দেশে কত ভূমিহীন নিঃস্ব মানুষ আছে যাদের পুনর্বাসন করা যাবে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনার ব্যয় দীর্ঘস্থায়ী লাভের বাণিজ্যিক প্রকল্পের মতো নিশ্চয়ই দেখা হয় না।

৩. জাতিসংঘের গোস্বা ভাসানচর প্রকল্পে তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। তারা যদি প্রথম থেকে নেতিবাচক থাকে তাহলে সম্পৃক্ত না-ও হতে পারে। তাদের রাজি করাতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা জাতিসংঘের অংশ, জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করতেই চাই। তবে বাংলাদেশ যদি বিশ্বব্যাঙ্ককে ছাড়া পদ্মাসেতু করতে পারে তবে জাতিসংঘকে ছাড়া ভাসানচরও করতে পারে-- একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির সেটা দেখানো ভালো। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা ভাসানচর দেখতে চাইলে সরকার নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। দেখে আসুন।

৪. আমাদের মিডিয়ার খবর ও ছবির সঙ্গে বিদেশী মিডিয়ার খবর-ছবির মিল নেই বলছেন। খবর পরিবেশনে অ্যাঙ্গেল বা দৃষ্টিকোণের পার্থক্য তো থাকেই। তবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পেতে চাইলে তা পাওয়া যায়। সন্দেহ হলে যেয়ে দেখে আসাই সমাধান।
কামাল ভাই, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে আপনার-আমার নীতিনিষ্ঠতার ভবিষ্যৎ কী জানি না। সংবাদমাধ্যম বিষয়ক যাবতীয় জ্ঞান ও স্বাধীনতা চর্চার অন্যতম সেরা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী শুরু হয়েছে, ‘ফেক নিউজ’ কে বলে আর কে কতভাবে করে, ফক্স নিউজ ও নিউজম্যাক্সের তেলেসমাতি তো সে-দেশের প্রেসিডেন্টের মদদেই হচ্ছে। পশ্চিমা সভ্যতাকে আদর্শ জ্ঞান করার দিন চলে যাচ্ছে।

৫. প্রশ্ন তুলেছেন, ভাসানচর প্রকল্পে আসলে কারা লাভবান হচ্ছে? ইঙ্গিত স্পষ্ট। চেটেপুটে খাওয়ার উদ্দেশ্যমূলক প্রকল্পের নজির তো আছে। তবে উড়ো সন্দেহের কথা না বলে মিডিয়া অনুসন্ধান করা ভালো। কারণ ফেসবুকের যুগে ঐ কথা ধরে রাজনৈতিক উড়ো মন্তব্য চলতে থাকে।

৬. আপনি পশ্চিমা মিডিয়ার ‘আইল্যান্ড প্রিজন’ শব্দটা উল্লেখ করেছেন। এ যুগে কোনো দ্বীপ বিচ্ছিন্ন থাকে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে, তাদের আমন্ত্রণ করে যে প্রকল্প হচ্ছে তাকে দ্বীপ-কারাগার বলা কি শোভন? আমরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়ার নউরু দ্বীপে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের অমানবিক পরিবেশে ফেলে রাখা নিয়ে আন্তর্জাতিক হৈ-চৈয়ের কথা জানি। ভাসানচর নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তি বেশি। সমুদ্র ঝাপিয়ে আসা উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের কোনো কোনো দেশ কী আচরণ করেছে? রোহিঙ্গারা কি সে-রকম আচরণ পেয়েছে? অবশেষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবশ্য কম-বেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে।

৭. দেশে দেশে শরণার্থী ও মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাগুলোয় কূটনৈতিক দিক বাদে মানবিক বিষয়ে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নেয় মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কর্মর্তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে। জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অনেক কথা আছে। এই কর্মকর্তারা সাধারণত দুর্গম জায়গায় কষ্ট করে না গিয়ে সুবিধায় থেকে কাজ সারতে চান। আন্তর্জাতিক আমলা ও কিছু এনজিও কর্মকর্তাও চাইবেন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাঁচতারা মানের হোটেলে থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে কাজ তদারক করে আসতে। স্বেচ্ছাসেবকদের যাতায়াতেরও প্রশ্ন আছে। তাই তাঁরা ভাসানচর পছন্দ করবেন না।

৮. কামালভাই আপনি আরেকটি পোস্টে এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, কারিতাস ও গণস্বাস্থ্য ছাড়া কোনো পরিচিত নামের এনজিও ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের কাজে যুক্ত হয়নি, অথচ ২০টির মতো অজ্ঞাত-অখ্যাত এনজিও কাজ করছে। আপনি ‘রাতের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হওয়া’র রাজনৈতিকভাবে তুলনাও টেনেছেন। আমার প্রশ্ন, মাত্র এক লক্ষ রোহিঙ্গার জন্য বড় এনজিওগুলোর যাওয়ার দরকার কি, যেখানে স্পর্শকাতর বিধায় সরকার নৌ-বাহিনী দিয়ে যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে কাজ চালাচ্ছে? অজ্ঞাত-অখ্যাত এনজিও কি কাজ করবে না? বড় যে দেশি এনজিওগুলো উখিয়া-টেকনাফ-কুতুপালং-কক্সবাজারে কাজ করছে তারা ভাসানচরের বিরোধিতা করেনি। জাতিসংঘ এজেন্সি, অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং থাইল্যান্ডের ফর্টিফাই রাইটসের মতো বিদেশি এনজিও বিরোধিতা করেছে। এই সংগঠনগুলো এবং বার্তা সংস্থা রয়টারের তোলা দ্বীপের বাসযোগ্যতা, নিরাপত্তা, জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা প্রভৃতি প্রশ্নগুলোর সমাধান করা হয়েছে বলে আমরা খবরে দেখতে পাচ্ছি। প্রথম দফায় যারা গেছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করেও নেওয়া হয়নি। এখন আপত্তি কেন? আন্তর্জাতিক মহলের পিঠ চাপড়ানি প্রশংসার দিকে তাকিয়ে আমরা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট মোকাবেলা করতে পারবো না। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কঠিন সমস্যাসহ আমাদের ছোট কাঁধে বিশাল বোঝার বাস্তবতা আন্তর্জাতিক মহলকে উপলব্ধি করতে হবে।

আরও পড়ুন:


সিটিভির ফুটেজে ধরা পড়ল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের সেই ঘটনা

ভারতের তৈরি টিকা নিয়ে করোনায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী!

যে সময় দোয়া পড়লে দ্রুত কবুল হয়

যে দোয়া পড়লে কখনো বিফলে যায় না!

কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে যে দোয়া পড়বেন!


news24bd.tv কামরুল