যেভাবে বঙ্গবন্ধুসহ স্বামী হত্যার খবর পেয়েছিলেন রাজিয়া নাসের!

যেভাবে বঙ্গবন্ধুসহ স্বামী হত্যার খবর পেয়েছিলেন রাজিয়া নাসের!

সোহেল সানি

ভোর তখন ছ’টা। ফজরের নামাজ আদায় করে বিছানায় গড়াগড়ি। চোখে ঘুম ঘুম ভাব, ঝনঝন শব্দে বেজে উঠে বেডের পাশে থাকা টেলিফোন। সাতসকালে ক্রিংক্রিং শব্দ মনে বিরক্তিকর ঠেকলেও ফোনটা রিসিভ হলো।

ওপাশ থেকে ভারীকন্ঠে ভেসে এলো বিষাদ বেদনার খবর, যা মৃত্যুসম যন্ত্রণা! নরম সুরে-ঢাকার কোনো খবর জানেন? ভাইয়ের সঙ্গে কি কথা হয়েছে? বুক ধুকধুক। বল্লাম হ্যাঁ কথা হয়েছে রাতে।

বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাছেরের সহধর্মিণী বেগম রাজিয়াকে এভাবেই টেলিফোন অপারেটর মকবুল জানিয়েছিলেন- ১৫ আগস্টের মর্মদহ ঘটনা। মকবুলের কাছে ফোনে বেগম নাসের জানান, তোমাদের ভাই ফিরে আসতে চাচ্ছিলো, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে প্রোগ্রাম থাকায় বঙ্গবন্ধু তাকে আসতে দিলেন না।

ফের মকবুলের প্রশ্ন- ভাবী, আপনি কি সত্যিই ঢাকা সম্পর্কে কিছুই জানেন না? বেগম নাছেরের উৎকন্ঠিত স্বর- না তো কিছুই জানিনা।  কেনো কি হয়েছে ঢাকার? নীরব কিছুক্ষণ। মকবুল রিসিভারটা ততক্ষণে রেডিও সঙ্গে মিলিয়ে দিলো।  আর তক্ষুনি সেই জল্লাদ কন্ঠ গরম শিশার মতো দুকান দগ্ধ করলো- আমি মেজর ডালিম বলছি...ততক্ষণে সব বুঝে গেলেন রাজিয়া নাসের। বুঝলেন স্বামীকেও তার বুক থেকে ঘাতকরা কেড়ে নিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হলো হৃদয়।

রাজিয়া নাসের তার স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় নিজেই লিখেছিলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে চেতনায় ঝরতে লাগলো ফোটা ফোটা রক্ত। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কি শুনলাম? একি সত্যি! আমার কষ্ট হচ্ছিল। খুবই কষ্ট।  যে বঙ্গবন্ধু জীবনের বারটি বছর বাংলার জেলখানায় কাটিয়েছেন, যে বঙ্গবন্ধু নয় মাস পাকিস্তানের জেলখানায় মৃত্যুর মুখোমুখি বসবাস করেছেন, যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা পর্যন্ত হত্যা করতে সাহস পায়নি, যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এদেশের দামাল ছেলেরা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য, সেই দেশের সেই ছেলেরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে? তা কি করে সম্ভব?  না, তা হতে পারে না।   কিছুতেই হতে পারে না।

তখন আমি মকবুলকে বললাম, বঙ্গবন্ধুর বাসা, মনির বাসা, সেরনিয়াবাতের বাসায় ফোন লাগাতে। এ বাসাগুলোর একটিতেও কেউ ফোন ধরলো না। তখন তৎকালীন যুগ্ম সচিব সৈয়দ আহমেদের বাসায় লাগাতে বললাম। সৈয়দ সাহেবকেও যখন পাওয়া গেলো না, তখন একেবারেই ভেঙে পড়লাম। বাসায় আমার এক ভাই থাকতো সে এবং ততক্ষণে আমার অন্য ভাইরাও চলে এসেছে। ওরা বললো- ও বাড়িতে কেউ বেঁচে নেই, তারা সবাই বললো।

ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী দৌড়ে এলো আমার বাসায়। একই খবর দিয়ে সে আবার দৌড়েই চলে গেলো। যেতে যেতে বললো, আমি যেনো এক্ষুণি বাসা ছেড়ে চলে যাই।  ভাইরা আমার বাড়ি নিয়ে গেলো। পেছনে পড়ে থাকলো বাসি বিছানা, বাসি ঘর দরজা, সকালের বাসি বাড়িটি। আর আমার এক জীবনের তাজা টকটকে স্মৃতি। সেই স্মৃতি হাতড়েই আজো নিশ্বাস নিচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর এই শ্যামল সোনালি বাংলায়।


আরও পড়ুন: পরীক্ষা না নিয়ে পাইকারি ফলাফল, শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্তই হবে


সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন চির অচেনার দেশে রাজিয়া নাসের। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরের সহধর্মিণী তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসা খুলনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেখ আবু নাসেরও ঘাতকদের বুলেটে নিহত হন। স্বামী নিহত হওয়ার সেই মর্মদন্ত খবর শুনতে হয়েছিল সাতসকালে টেলিফোনে। টেলিফোন অপারেটর মকবুল নিজমুখে এ মর্মস্পর্শী খবরটি দিতে পারছিলেন না। তাই মকবুল রেডিওতে রিসিভার চেপে ধরে নরঘাতক মেজর ডালিমের কন্ঠে শুনিয়েছিলেন হত্যাকাণ্ডের খবর। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা আবু নাসেরের সহধর্মিণী সাত সন্তানের জননী বেগম রাজিয়া নাসেরের জীবনে নেমে এসেছিল করুণ পরিণতি। যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। স্বামীহারা রাজিয়া নাসের শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখেও সন্তানদের বুকে আগলে রেখে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। দুই পুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বাগেরহাট থেকে। আরেক পুত্র শেখ জুয়েলও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন গত নির্বাচনে। নাতি শেখ হেলালের পুত্র শেখ তন্ময়ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে রাজনীতির আলোচনায় নাম লিখিয়েছেন।


আরও পড়ুন: মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কি?


বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার প্রতি স্নেহ ভালবাসা প্রদর্শন করে চাচী হিসেবে রাজিয়া নাসের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চাচীর মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। চাচীর অবদান সম্পর্কে তিনি রোজনামচায় লিখেছেন নানা স্মৃতিকথা। বলেছেন আমাদের চাচী ইতিহাসের পাতায় চিরদিন বেঁচে থাকবেন।  কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় চাচী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন (শেখ রুবেল)। স্বামীর মুখখানা একটিবার দেখার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। টুঙ্গিপাড়া ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু এ বাড়িতেও তাকে পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। ফিরে যান খুলনার বাড়িতে কিন্তু সেখানেও  তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনা লিখেছেন, আমার চাচার ব্যবসা ব্যাংকের হিসেব বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের পরিবারের ১৮ জন সদস্য হত্যার পর সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন, সবচেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন আমার একমাত্র চাচী রাজিয়া নাসের। একজন নারী ঘরহীন হয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাতটা সন্তানকে মানুষ করেছেন। মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই তাঁকে জান্নাতবাসী করবেন।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

news24bd.tv আহমেদ