‘আমি কাউকেই পাইনি একটু হেলান দেওয়ার মতো’

‘আমি কাউকেই পাইনি একটু হেলান দেওয়ার মতো’

সাদিয়া নাসরিন

কোনো কোনো সময় জীবন মানে কিছুই না। হয়তো শুধু শুধুই ফুল ফোটে, শুধু শুধুই বর্ষা নামে, জোছনার ফিনকি ঝরে তাও অকারনেই। এমন সময় জীবনানন্দের মতো “জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেল” সবই অসহ্য বোধ হয়, মর্গেই হৃদয় জুড়োতে চায়।

আজ বিকেলেও আম্মার বিছানায় শুয়ে শুয়ে চরম খিটখিটে মেজাজে মনে হচ্ছিলো, “অর্থ নয়, কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়/ আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে/ আমাদের ক্লান্ত করে/ক্লান্ত-ক্লান্ত করে...”

তবুও পরমুহূর্তেই এমন কোন আলো জ্বলে ওঠে যে, জীবন ভীষণ সুন্দর আর অর্থবহ হয়ে ওঠে।

সেইসব “সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা” দেখতে দেখতে বুঝা যায় জীবনের অনেক রকমের মানে আছে।

আজ সন্ধ্যা নামার একটু পরে ঢাকা এয়ারপোর্টে লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, এমন সময় একজন মাঝবয়সী সৌম্য দর্শন মানুষ এগিয়ে এসে কথা বলতে চাইলেন। আমি সম্মতি দিতেই বললেন, “আপনি কি জানেন, আপনার প্রতি আমার পরিবারের অনেকটুকু ঋণ আছে?” আমি এসব পরিস্থিতে খুব নার্ভাস হয়ে যাই। কোনরকমে বিষ্ময় সামলে জানতে চাইলাম, কীরকম !

তিনি তাঁর স্ত্রীর পরিচয় জানিয়ে বললেন, “আমাদের একমাত্র সন্তানটি কিশোর গ্যাং ট্যাং এসবে ইনভলব হয়ে গিয়েছিলো, ড্রাগ ট্রাগও নেয়া শুরু করছিলো।

আমার স্ত্রী ব্যাংকার, আমি ব্যবসা করি। আমরা কেউই তেমন করে তার প্যারেন্টিংটা করতে পারিনি। আপনার একটি লেখা পড়ে আমার স্ত্রী খুব নাড়া খেয়েছিলো। এরপর সে ইনবক্সে আপনার সাথে কথাও বলেছিলো। আপনি সেই ব্যাক্তি যে আমার স্ত্রীকে সাহস দিতে পেরেছেন আমাদের একমাত্র সন্তানকে ফিরিয়ে আনার কষ্টটুকু নেওয়ার। আপনার পরামর্শে আমরা তাকে কাউন্সেলিং করিয়েছি, তার সাথে ইন্টিমেট হয়েছি। আপনি নিজে থেরাপিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করে দিয়েছেন, নিয়মিত খোঁজ খবর নিয়েছেন.... আল্লাহর রহমতে সে রিকভার করেছে, এডুকেশনে ফিরে গেছে। আমি জানিনা আপনাকে কী বলা উচিত...আপনি কি একদিন আমার বাসায় আসবেন ?”

আমার চোখে কেন জল আসলো আমি জানিনা। কতো বাতি আমার অজ্ঞাতেই জ্বলে যায়, অথচ যে বাতিগুলো আমি জ্বালাতে চাই সর্বস্ব বাজি ধরে, সেই বাতিটাগুলো জ্বালাতে পারিনা!! তবুও কোথাও না কোথাও, কারো না কারো কাছে আমার জীবনের এতো উজ্জ্বল মানে আছে!!

আরো দু’বছর আগে ঠিক এই দিনে ইনবক্সে এক মেয়ে কল করে হাউমাউ করে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বারবারই বলছিলো, "দিদি, আজ সকালে আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্ত তোমার আজকের লেখাটা পড়ে মনে হলো আরেকবার চেষ্টা করি.....তুমি কখনো জানবেনা আজ থেকে তুমি আমার কতটুকু হলে"। সেদিন আমার নিজের মনই এতো খারাপ ছিলো যে, আমি ঘরছাড়া গান শুনতে পাচ্ছিলাম ভেতরে। তবু সেদিন সেই আলো মরতে থাকা বিকেলে মেয়েটির কথা শুনে আমার মনে হয়েছিলো, এ-ই আমার জীবনের মানে।

সেবছরই, যুক্ত'র নবান্ন উৎসবে গিয়েছিলাম। উৎসব শেষে বের হওয়ার সময় কান্তদেহী অচেনা এক নারী এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বিষ্মিত আমি প্রায় যখন নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিলাম তিনি আমাকে চেনেন না অন্য কেউ বলে ভুল করছেন, ঠিক তখনই আমাকে একেবারে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বললেন, "আপনার লেখা আমি বুকের ভেতরটা দিয়েই পড়ি। আমার শক্তি ফিরে পাই আপনার লেখা পড়ে। ".... সেই সকালে উনার হাতের মুঠোয় আটকে পড়া হাতটি বুঝতে পারছিলো এটাই আমার জীবনের মানে।

এই জীবনে কতোবার আমি নিজেই পথ হারিয়েছি, হোঁচট খেয়েছি, কাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত হয়েছি। সেই দিনগুলোতে আমি নিজেই কতোবার দিশেহারা হয়েছি। কতো বিষাদের ভোরে মৃত্যু এসে কড়া নাড়িয়ে গেছে!!

আরও পড়ুন: ‘মেয়েরা প্রকাশ্যে সিগারেট খেলে খারাপ লাগে’

আমি কাউকেই পাইনি একটু হেলান দেওয়ার মতো। কান্না গিলে গিলে, আগুন প্রসব করে করে জীবন কুড়িয়েছি অন্ধ দুয়োরাণীর মতো। তবু কুড়িয়ে পাওয়া এসব ভালোবাসার কারণেই জীবনটা অসম্ভব রকমের অর্থবহ হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, ‘কতো লক্ষ জনম ভ্রমণ করে এমন মানবজীবন মেলে!’

হায় লেখা, কতো অচেনা পাথরে এনে মিলিয়ে দিলে তুমি আমার গোপন সীমানায়!!

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর