নিজেকে জানাটা সবচেয়ে কঠিন

নিজেকে জানাটা সবচেয়ে কঠিন

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

সক্রেটিসের সব সময় বলতেন ‘নিজেকে জানো’। খুব কঠিন একটা কথা। আমৃত্যু মানুষ নিজেকে জানার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় কিন্তু নিজেকে কি জানতে পারে। প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো একটা অবস্থা হয়তো তৈরি হয় তবে সত্যটা বেরিয়ে আসার আগেই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়।

পৃথিবীতে অন্যকে জানা যতটা কঠিন নিজেকে জানা তার থেকেও আরও কঠিন।

পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী গ্রিসের থেলিস বলতেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে উপদেশ দেওয়া। যদিও প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার জীবনবোধের অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করতেন, একজন মানুষকে সত্যিকারভাবে জানার উপায় হচ্ছে তার স্বপ্নটা জানা। হয়তো অন্যকে স্বপ্ন দেখানো যায়, অন্যের স্বপ্নটা বোঝার মতো করে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির তৈরি করা যায়, কিন্তু নিজের স্বপ্নটা মানুষ কি কখনো নিজে দেখতে পারে।

নিজেকে জানা যতটা কঠিন নিজের স্বপ্নকে জানাও ততটা কঠিন। কারণ মানুষ যখন নিজের স্বপ্নকে দেখার চেষ্টা করে তখন কঠিন বাস্তবতা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে আমরা যতটুকু দেখি ততটুকু না দেখার মতো। নিজেকে জানার জন্য যে নিজের গভীরে যেতে হয় সে যাওয়াটা হয়তো কখনোই হয়ে ওঠে না। বরং নিজেকে জানাটা অনেকটা ভাসা ভাসা ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি শুধুই পেলাম ছলন ‘ এর মতো।

বোধ হয় নিজেকে চেনাটা, নিজের স্বপ্নটাকে খোঁজাটা আইসবার্গ থিওরির মতো। যেখানে বলা হচ্ছে, একটি বরফ খণ্ডের ১০০ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠের ওপরে থাকে। বাকি ৯৫ ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠের নিচে থাকে। অধিকাংশ মানুষই সমুদ্র পৃষ্ঠের ওপরের এই ৫ ভাগকেই সমগ্র বরফখণ্ড হিসেবে ভেবে নেন এবং ভুলে যান যে এর বেশিরভাগ অংশই অদৃশ্য। এই  আইসবার্গ থিওরির মতো নিজেকে জানার দৃশ্যমান সামান্য অংশটুকু দেখে আমরা নিজের অদৃশ্যমান বেশিরভাগ অংশটুকু দেখতে পাইনা।

ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে বলতেন ‘আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি। ’ তবে এই চিন্তাটা মন না আত্মা থেকে আসে সেটার কোনো বিহিত তিনি করতে পারেননি। মন ও আত্মা ভিন্ন হলেও তিনি দুটোকে এক ভেবে গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে যার মধ্যে চিন্তা করার শক্তি আছে সে যে নিজেকে জানার জানালাটা খুলতে পারবে তা বোধ হয় বলা যায়। তবে দেকার্তের চিন্তার সূত্রটা যখন উল্টে ফেলে নিজের দিকে তাকাই, তখন কথাটা খুব সম্ভবত আমি আছি তাই চিন্তা করতে পারি এমন করেই বলতে হয়। কোনটা নিজেকে জানা আর কোনটা অজানা সেটা একটার পর একটা থিওরির দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা সম্ভব নয় যতটা সম্ভব ততটাও নয়।

লিও তলস্তয় বলতেন, ‘সবাই ভাবে পৃথিবীকে বদলে দেবে, কিন্তু কেউই নিজেকে বদলানোর কথা ভাবে না। কথাটা অমৃত সমান। যে নিজেকে চেনে না সে নিজেকে বদলাতে পারে না। পৃথিবী বদলানোর মতো শক্তিও তার থাকে না। বাস্তবে মানুষ  নিজেকে হয়তো জানতে পারে। তবে সে জানাটা মানুষকে সাহসী না করে ভীত করে। নিজেকে জেনে মানুষ পিছিয়ে পড়ে। ভয়ে কেঁপে ওঠে। কারণ সে জানাতে হয়তো আলো থাকে না, অন্ধকার থাকে। পুণ্য থাকে না, পাপ থাকে। মানুষের মতো মানুষটা থাকে না, দৈত্যের মতো দানবটা থাকে। যে মানুষটা জানে তার ভেতর যা কিছু আছে তার সব মন্দ, সে নিজেকে কখনো জানতে চাইবে না। একজন অপরাধীর অপরাধবোধ থাকতে পারে, সে জানে অপরাধবোধ অনুশোচনার জন্ম দেয়, সে বোধটা ভালো। তবে তা দিয়ে তো অপরাধ মোচন হবে না। প্রতিটা মানুষ হয়তো নিজেকে একটা সময়ে এসে জানে। সেটা কখনো আলো দেখে না, গোপন দহনের তীব্র আগুনে প্রতিদিন নিঃশব্দে গুমরে গুমরে মরে হয়তোবা। ইতিহাস থেকে অনেক প্রেমপত্র আমরা খুঁজে পাই। তবে সেটা কতটা নিজেকে জানা, কতটা আবেগ, কতটা কল্পনা তা যে লিখে সে হয়তো জানে আর পৃথিবীর কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব হয় না। যেমন সত্যটা কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা তা হয়তো সময় জানে। প্রকৃতি জানে মানুষ জানে না।

জন কীটস  ফ্যানি ব্রাউনিকে চিঠি লিখেছিলেন, ভালোবাসা আমাকে স্বার্থপর করেছে ৷ তোমাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই৷ আমি প্রায় সবকিছুই ভুলে যাই, কিন্তু তোমাকে আবার দেখার কথা ভুলতে পারি না৷ এলিজাবেথ টেলরের সৌন্দর্যের উপাসনা করে রিচার্ড বার্টন লেখেন, তুমি অবশ্য জানবে না, তুমি চিরকাল কী আশ্চর্যরকম সুন্দর৷ এও জানবে না যে, কী চমৎকার বিপজ্জনক রমণীয়তা তোমার অর্জিত, যা তুমি যোগ করেছ তোমার লাবণ্যে৷

চার্চিল তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ভালোবাসার যদি কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, তবে তোমার কাছে ঋণে আমি যার পর নাই খুশি৷ তোমার সঙ্গে আর তোমার হদয়ে বেঁচে থাকার এ অনুভূতি, আমি কোনো ভাষায় বা প্রকাশ করব৷ সব চিঠির মধ্যে যে ব্যাকুলতা আছে তাতে ভালোবাসা কতটা সত্য, কতটা মিথ্যা তা যারা লিখেছেন তারা হয়তো জানতেন। তবে  নিজের ভেতরের সত্যটা কতটা কঠিন সত্যের সাথে লড়েছে সেটা বোধ হয় ইতিহাস বিচার করবে। যে বেকার ছেলেটার পায়ের জুতো পিচ ঢালা কঠিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ক্ষয়ে গেছে। সে জানে না তার চাকরিটা হবে কিনা। যে মধ্যবিত্ত মানুষটা দিন আনে দিন খায় সে জানে না আগামীকালটা তার কী হবে। যে মানুষটা ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর দিন গুনছে সে জানে না কখন তার মৃত্যু হবে। যে মানুষটা প্রতিদিন সত্যের জন্য লড়াই করছে সে জানে না এই সত্যের জন্য চরম মূল্য তাকে দিতে হবে কিনা। মায়ের মুখটা যে ছেলেটা অনেকদিন দেখেনি সে জানে না তার মাকে আর কোনোদিন দেখবে কিনা। বাবার ক্লান্ত দেহটা আর কখনো মায়াবী চোখে সন্তানদের মুখ দেখবে কিনা বাবা তা জানে না। এই না জানাটাই হয়তো নিজেকে জানা। সব হারিয়ে যে পথে নেমেছে তার মূল্য কতটুকু সে কি কখনো জানতে পারে। মানুষের দুঃখে যে ঝাঁপিয়ে পড়তো আজ তাকে দেখার ও জানার কেউ নেই। আপন কখন পর হয়েছে কেউ জানেনি, বোবা কান্নাটা হয়তো জেনেছে। সব জানাগুলো কখন যেন নদীর জলে ডুবে মরেছে। মাটিতে আছড়ে পড়েছে বিবর্ণ গিটার কোনো হারানো পথে। এমন করে নিজেকে জানতে গিয়ে মানুষের প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া আর শুন্যতায় ঝুলে ঝুলে বাদুড়ের মতো নিজেকে খোঁজা।

আরও পড়ুন: ‘৩০ বছর মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন জিয়া, এরশাদ ও খালেদা’

বিত্তশালী মানুষ গুণি তুলনায় বেশি প্রাধান্য পায়

‘গবেষণা আমাদের বিশ্বাস ও বিজয়’

একটু উদার হই

সে যাই হোক, মানুষ নিজেকে না জেনেও জানুক। আরো জানুক, অনেক বেশি করে জানুক। নিজের জানাটাকে আত্মশুদ্ধির শক্তি হিসেবে নিজের ভেতর থেকে বের করে আনুক। নিজের জানাটাকে নিজের জ্ঞানের গভীরতা থেকে টেনে এনে আয়নার কৃত্রিম কাচটাকে ভেঙে ফেলুক। মানুষ স্বপ্ন থেকে জানুক। আলো থেকে জানুক। অন্ধকার থেকে জানুক। শহরের রাজপথের মানুষের কোলাহল থেকে মানুষ নিজেকে জানুক। হোক সেটা ভালো কিংবা মন্দ।

news24bd.tv তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর