আমরা যে যাই ভাবিনা কেন পৃথিবীতে একজন মানুষের সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটা বেশি আনন্দের | বেশি অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক। আমরা সবাই হয়তো বিষয়টা জানি। তারপরেও দেখা যায়, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই অসাধারণ হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই অসাধারণের পিছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ জীবনের অনেক মহামূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলে।
যেটা হারিয়ে যায় সেটা আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়না। কারণ সময় খুব নির্মম হয়, একবার সময় অতিক্রান্ত হলে তা আর কখনো ফিরে আসেনা। তখন সেটা হয়ে যায় দুঃসহ অতীত।জীবনের কঠিন সময়ে এসে মানুষ বুঝতে পারে সে কি হারিয়েছে।
দুঃসময়ে এই প্রিয়জনরাই কাছে থাকে, বেঁচে থাকার নির্ভরতা হয়। শক্তি ও সাহস হয়। অথচ সুসময়ের স্বার্থপর মানুষগুলো তখন খুব অচেনা হয়ে যায়। চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে মাথাগুলো মাটিতে আর পা গুলো আকাশে ছড়িয়ে নতুন আরেক শক্তিকে আঁকড়ে ধরার প্রতিযোগিতায় নামে। একদিন যে স্বার্থপর হাতগুলো ছাতা মেলে ধরেছিলো মাথার উপরে সে হাতগুলো সরে গিয়ে বিশ্বাসঘাতক হয়। পলাতক হয়। মানুষ অসাধারণ হতে গিয়ে অনেক সময় জীবনের মূল্যবোধগুলোকে হারায়। যেমন ক্ষমতার লোভ মানুষকে জাপটে ধরে। সেই ক্ষমতা হোক ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক।
মানুষ একটা সময় ভাবতে শুরু করে এ ক্ষমতা সারাজীবন তার হাতে থাকবে। এ সময় মানুষ নিজেকে চিনতে পারেনা । অচেনা একটা সত্তা নিজের চেনা সত্তার সাথে লড়তে লড়তে একদিন হেরে যায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মতো ক্ষমতার দৈন্যতা মানুষকে আপনজন থেকে ক্রমাগত অনেকটা অজ্ঞাত ঠিকানায় নিয়ে যায়। যেখানে একটা পুরাতন শেকড়ের ঠিকানা কাগজে লেখা থাকে কিন্তু সে লেখাটা পড়া যায়না। বোঝা যায়না । মাথায় ঢুকানো যায়না । ক্ষমতায় অসাধারণ মানুষটা যখন ক্ষমতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়। তখন মেঘ হারিয়ে ফেলে আকাশ। শব্দ হয় নিঃশব্দ। উধাও হয় প্রতিদিনের কোলাহল। উপরে থাকা মানুষটা ধপ করে মাটিতে নেমে আসে। চেনা মানুষ, চেনা জনপদ। সব অচেনা হয়ে যায়।
সুবিধাবাদী মানুষগুলো তাদের সুবিধাবাদী মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেলে আরেক ক্ষমতার বলয়ে রং পাল্টায়। রূপ পাল্টায়। তখনো পরিবারের প্রিয়জনরাই দু'হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ প্রিয়জনদের কাছে মানুষটা অনেক বড় ছিল, তার ক্ষমতাটা নয়। অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদদের দেখেছি। তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের চারপাশে অনেক কৃত্রিম মানুষের ভিড় ছিল।
কৃত্রিম মানে যে মানুষগুলো নিজেদের স্বার্থের টানে কাছে এসেছিলো। তারা মানুষটার চেয়ে মানুষটার ক্ষমতাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলো। তেমনি যে রাজনীতিবিদ একসময় পথঘাট দাপিয়ে বেড়াতেন, বয়সের ভারে যখন নুয়ে পড়েছেন । যখন তার চোখ অসংখ্য ফেলে আসা মানুষকে খুঁজছে, তখন তার পাশে কেউ নেই । মানুষটা ধুঁকে ধুঁকে মরেছে, চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়েছে । কিন্তু স্বার্থপর মানুষের আর খোঁজ মেলেনি । সাধারণ থেকে অসাধারণ হতে গিয়ে মানুষ নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার চারপাশের পৃথিবীর অনেক কিছুই তার অদেখা থেকে যায় । সেটা আর কখনোই দেখা হয়না । একটা সাধারণ দিন মজুর । তার অর্থের অভাব থাকতে পারে । জীবনে অনেক টানাপোড়েন থাকতে পারে । কষ্টের আর কান্নার তীব্র জ্বালা থাকতে পারে । কিন্তু সে জীবনের সুখ-দুঃখের এপাশ-ওপাশটা যেভাবে দেখতে পারে তা অসাধারণ একটা মানুষ পারেনা ।
মানুষ এমন অনেক কিছুতে অসাধারণ হতে চায় । অসাধারণ হওয়াতে দোষ নেই । যখন অসাধারণ থেকে সাধারণ মানুষটা হারিয়ে যায় তখন সব হারিয়ে যায় । মায়ের হাসিমুখ, বাবার মায়াবী চোখ, সন্তানের আদুরে হাত, প্রেয়সীর ভালোবাসা । ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া । আনন্দ বেদনা । সব যেন নির্বাসিত হয়। সময়টাই যে তখন এমন রঙে রসে ভরা থাকে । উড়ন্ত ফানুস তখন মানুষ দেখলেও মানুষ বাস্তবতার রুগ্ন রূপটা দেখতে চায়না ।
আমার একজন কাছের মানুষের একটা কথা মনে পড়ে গেলো । কথাটা এমন : সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটা অনেক কঠিন। এ কথাটাও তো ফেলে দেবার নয় । একটা মানুষ যখন সাধারণ থাকে তখন অনেক শুকুন মানুষ তাকে ক্ষত নিখুঁত করে । তাকে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালের কাছে এনে বুকে একটা পেরেক মেরে দেয় । যাতে করে সাধারণ মানুষটা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে । অসাধারণের মুখটা দেখতে গিয়ে সাধারণের মুখটা দেখতে পেলাম । কোথায় যেন মিল-অমিল । চেনা-অচেনা । তরপরও কঠিন সত্যকে বের করে আনার সাধারণ লড়াইটা চলুক ।
সাধারণ মানুষ হোক অসাধারণ আর অসাধারণ মানুষ হোক সাধারণ। সমীকরণটা মিলুক আর না মিলুক । দর্শনটা যেন শক্ত হাড়ের উপর দাঁড়িয়ে মনস্তত্বের সাথে মাংস খন্ডের মিলন ঘটায়। মানুষ মানুষ হয়ে উঠুক চিন্তায়, মনুষত্বে আর মানবিকতায় । তখন সাধারণ আর অসাধারণ মানুষ থাকবেনা, দূর্বাঘাসে পড়ে থাকবে শীতের শিশির । এক খন্ড কুয়াশা । শীতের চাদর আর মানুষের শীতার্ত শরীর । আর পড়ে থাকবে একটা অসমাপ্ত উপসংহার ।
news24bd.tv নাজিম