স্যার আবেদ বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে

স্যার আবেদ বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে

শরিফুল হাসান

স্যার ফজলে হাসান আবেদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আজ আমার বক্তব্য শুরু করেছিলাম অভিবাসন নিয়ে বিএমইটি ও ব্র্যাক আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের একটা অনুষ্ঠানে। সেখানে বলেছিলাম আমাদের জন্য দিনটা শোকের। কিন্তু অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মাননীয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদ স্যার সেই অনুষ্ঠানেই বললেন, স্যার আবেদদের মতো মানুষের কোন মৃত্যু নেই। কাজেই শোক নয় আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত এই মহামানবেরা পৃথিবীতে এসেছিলেন।

 

কথাটা মনে ধরল। আসলেই তাই। মানুষের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে একজন মানুষ যে তার চারপাশ, তার দেশ, এমনকি পৃথিবীও বদলে দিতে পারেন সেটা স্যার ফজলে হাসান আবেদ দেখিয়েছেন। তার ভাবনাজুড়ে ছিল শুধু মানুষ।

সে কারণেই তো মৃত্যুর আগে তিনি বলতে পারেন, ‘আমি তৃপ্ত যে আমার জীবন বৃথা যায়নি। ’

স্যার আবেদ আমার কাছে একটা জাদুকাঠির নাম। ২০০২ থেকে ২০১৭, টানা ১৫ বছর সাংবাদিকদের সুবাদে এদেশের অনেক মানুষকে কাছ থেকে দেখা হয়েছে। দূর থেকে একজনকে যতটা বড় মনে হয়, কাছে গেলে অনেক সময়ই সেই বড়টা আর লাগে না। অথচ আবেদ ভাইয়ের কাছাকাছি গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি আমাদের জানার চেয়েও অনেক বড়। কিন্তু, ভীষণ বিনয়ী। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে নানাজনের স্মৃতিকথায়ও সেগুলো উঠে এসেছে।

আমি সবসময় বলি, বাংলাদেশে অনেক বড় মাপের মানুষ আছেন। তারা অনেক বড় বড় কাজও করেছেন। কিন্তু, খুব কম মানুষই আছেন যিনি ব্যক্তিপরিচয় ছাপিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়েছেন! কিন্তু, শুরু থেকে ব্র্যাককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন স্যার আবেদ। নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানেও অন্যদের মতো তিনিও বেতনভুক্তই ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমি ব্র্যাক থেকে বেতন নিই। কিন্তু, আমার নিজের কিছু নেই। নিজের বাড়ি নেই, ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখনই নিজের জন্য কিছু করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবসা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না। ’

আপনারা অনেকেই জানেন, ব্র্যাকের জন্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফজলে হাসান আবেদ তখন শেল কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। সেই চাকুরি ছেড়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ করেন। দেশ স্বাধীনের পর লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিয়ে বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেন। সেই যে শুরু হলো, আজ সেই প্রতিষ্ঠানের বয়স ৪৯ বছর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা আজ ব্র্যাক।

আমি ব্র্যাকের অতীত ইতিহাস পড়ি আর মুগ্ধ হয়ে ভাবী- একটা প্রতিষ্ঠান কী করে এত কাজ শুরুর সাহস করল। ১৯৬৮ সালে খাবার স্যালাইন তৈরি হলেও দেশের মানুষ জানত না। ফলে ডায়রিয়ায় প্রচুর লোক মারা যেত। বাড়ি বাড়ি খাবার স্যালাইন নিয়ে গেল ব্র্যাক। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে একজন নারীকে লবণ-গুড়ের স্যালাইন বানানো শেখাতে ব্র্যাকের সময় লেগেছিল ১০ বছর। ফল ডায়রিয়ায় মানুষের মৃত্যু কমে এলো।

বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু কমাতে এবং শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য টীকা প্রদানের যে কর্মসূচি তাতে মূল ভূমিকা রেখেিছলেন স্যার আবেদ। ১৯৮০ সালে স্যার আবেদ  সরকারকে টীকা কর্মসূচি শুরুর প্রস্তাব দিলেও সরকার ১৯৮৬ সালে পুরোদমে কাজটি শুরু করতে রাজি হলো। তবে শর্ত হলো বাংলাদেশের চার বিভাগের মধ্যে দুটিতে কাজ করবে ব্র্যাক। বাকি দুটিতে সরকার।

অবাক করা বিষয় হলো- যে দুই বিভাগে ব্র্যাক কাজ করেছিল, সেখানে ৮০ শতাংশ শিশুর টিকাদান সম্পন্ন হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃতি দিল ব্র্যাককে। দেশজুড়ে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে এই টীকা কার্যক্রমের ভূমিকা বিশাল।

ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর কাজটিও মুগ্ধকর। আড়ং থেকে শুরু করে ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মসূচিই সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ব্র্যাকের নেতৃত্বদান সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত।

বাংলাদেশ ছাড়াও আরও ১১ দেশে কাজ করছে ব্র্যাক। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে কার্যালয় আছে ব্র্যাকের। আফ্রিকার দেশগুলোতে যদি আপনি বাংলাদেশ বলেন তা হলে তারা বলবে শান্তি মিশন নাকি ব্র্যাক? ভাবতে দারুণ লাগে আফ্রিকার কোনো এক দেশে সড়কের নাম ব্র্যাক।


আরও পড়ুন: এতো ভ্যাকসিন ভারত কোত্থেকে নিচ্ছে?


আসলে মানুষের জীবন পরিবর্তনে যত কিছু লাগে, প্রত্যেক কাজে স্যার আবেদ শরিক হয়েছেন। শুধু কয়েকটা ছোটখাটো দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নয়, সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে গেছেন এবং তিনি সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ব্র্যাকের সঙ্গে জড়িত।

স্যার আবেদকে নিয়ে নানাজনের স্মৃতিকথা পড়ছিলাম। তামারা আবেদ আপা যেমনটা লিখেছেন, স্যার আবেদ অর্থ বৈভব, খ্যাতি বা ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি। তিনি মানুষের জন্য কাজ করে তৃপ্তি পেয়েছেন। জীবনের সাধারণ আনন্দগুলো থেকে তিনি সুখ খুঁজে নিয়েছেন। সর্বোপরি জীবন ও মানুষের প্রতি আগ্রহ তাঁর প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করেছে। এটাই তাঁর জীবন থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
 
আমি বিশ্বাস করি স্যার আবেদ বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। আর তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, কৌশল বজায় রেখে নিশ্চয়েই আরও এগিয়ে যাবে  এই বাংলাদেশ।

শরিফুল হাসান, সিনিয়র সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী

news24bd.tv আহমেদ