বঙ্গবন্ধু 'জয়বাংলা' কথাটা আত্মস্থ করেন কবি নজরুলের মুখ থেকে!

সোহেল সানি

বঙ্গবন্ধু 'জয়বাংলা' কথাটা আত্মস্থ করেন কবি নজরুলের মুখ থেকে!

সোহেল সানি

ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মতে, 'সুস্থ সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ স্বাধীনতাকে সংহত করে। আর অসুস্থ অপসংস্কৃতি স্বাধীনতাকে করে সংহার। ' ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীকার থেকে  স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতির প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুগভীর। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিশ্বাস থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর অন্তরের সংযোগ ঘটিয়ে ছিলেন।

যার প্রকাশ ঘটান স্বাধীনতার আগে এবং পরে।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করায় বঙ্গবন্ধু বিচলিত হয়ে হয়ে পড়েছিলেন।  ৬ দফা নিয়ে তখন তাঁর কর্মব্যস্ততা। এর মধ্যেও একটি বড়সড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বলেন জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে।

কলেজ চত্বরে অন্তত দশ হাজার শ্রোতামন্ডলি ছিল সেই অনুষ্ঠানে। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ছিন্ন করে অনুষ্ঠানে আকষ্মিকভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীতও পরিবেশন করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সরকার। পূর্ববাংলার গভর্নর মোনায়েম খান প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানকে প্রত্যাহার করে। আর অধ্যাপক অজিত গুহকে বিতাড়িত  করেন কলেজ থেকে। নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে জগন্নাথ কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়।  

বঙ্গবন্ধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত ছিলেন। বিভিন্ন বক্তৃতায়  কিংবা জ্বালাময়ী ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে 'কবিগুরু' সম্বোধন করে কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করতেন। কোনো আন্দোলন সংগ্রামের প্রশ্নে  সমমনাদের সঙ্গে বনিবনা না হলেই বক্তৃতায় জুড়ে দিতেন কবিগুরুর "কেউ যদি তোর ডাক শুনে না আসে , তবে একলা চলে..রে' সঙ্গীতের চরণ।  

পাকিস্তান কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানের গণসমুদ্রে দাঁড়িয়ে যে আবেগঘন ভাষণ দেন, তাতে রবীন্দ্রনাথের বাঙালি করে রেখেছো মানুষ করোনি কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে খুশীর বার্তা দিতে বলেন, কবিগুরু তুমি দেখে যাও বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।   

রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রবল আসক্তি থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই 'আমার সোনার বাংলা' সঙ্গীতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেন।

সমভাবে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের প্রতিও প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। সামরিক বাহিনীর রণ সঙ্গীত হিসাবে বেছে নেন নজরুলের 'চল চল চল উর্বধে গগণে..' কবিতাটিকে।  

বাঙালির মুক্তির মন্ত্র অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান রূপে 'জয়বাংলা' কথাটাও নজরুলের একটি গান থেকে আবিষ্কার করেন। কবি নজরুল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে মাদারীপুরে এসেছিলেন কারামুক্ত  চরমপন্থী নেতা পূর্ণচন্দ্রের সম্বর্ধনা সভায়। কবি তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি কবিতায় জয়বাংলা শব্দটি ব্যাবহার করেন।

ওই সভায় উপস্থিত শেখ মুজিব জয়বাংলা শব্দটি আত্মস্থ করেন। মুজিব অনুসারীরাও মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতির দাহ্যগুণ উপলব্ধি করেছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষে যে লৌহদৃঢ় ঐক্য গড়ে ওঠে তাতে সংস্কৃতির অবদান অসামান্য। ১৯৭৩ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আবদার করে অসুস্থ ও নির্বাক কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদায় আসীন করেন।  

উল্লেখ্য, বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে, রবীন্দ্র-নজরুল দুই বরেণ্য কবিরই স্বপ্ন অখন্ড বাংলাকে ঘিরে। রবীন্দ্রনাথ "আমার সোনার বাংলা" সঙ্গীতটি রচনা করেন ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকালে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাংলা আবারও এক হয়। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরি চালিয়ে সাতচল্লিশে বাংলা আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়। এর সাত বছর আগেই রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের বাংলাদেশ প্রবন্ধও অখণ্ড বাংলাদেশ নিয়ে। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগকালে নজরুল ছিলেন নির্বাক।

রবীন্দ্র-নজরুলের পূর্ববাংলায় বসতি থাকলেও দুই নক্ষত্রেরই জন্মস্থান পড়েছে পশ্চিম বাংলায়। পশ্চিম বাংলা, পূর্ববাংলার চেয়ে আয়তনে বড় হলেও তা রাষ্ট্র নয়,পরাধীন রাজ্য- ভারতের প্রদেশ মাত্র।  সাতচল্লিশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত  লাখো হিন্দু-মুসলমানের রক্তের বিনিময়ে বাংলা পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত হয়।  পূর্ববাংলার ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে রূপান্তর  ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ-এ।


অস্ত্র বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল গ্রেপ্তার

৫০ বছর পর ভাস্কর্যের কথা মনে পড়ল কেন?

ঢাকা মহানগরে হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হক


১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে দেয়া বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান 'পূর্ববাংলার' নাম 'পূর্বপাকিস্তান' রাখার তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, "The word 'Bengal' has a history, has a tradition of its own. প্রসঙ্গতঃ শেখ মুজিব যাঁকে লিডার বলে সম্মোধন করতেন, সেই গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই তখন গণপরিষদ নেতা হিসাবে পাকিস্তানের  প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রের ন্যায় পূর্বপাকিস্তানেও তখন আওয়ামী লীগ সরকারে।  

সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষেই কেবল সম্ভব হয় পূর্ববাংলার নাম বাংলা অথবা বাংলাদেশ রাখার দাবি তোলা।  
টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনের সঙ্গে আয়োজন করা হয়েছিলো বিরাট এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ১৯৫৭ সালের ৮-৯-১০ ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মিশর, জাপান ভারত থেকে খ্যাতনামা শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এতে অংশ নেন। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন, কাগমারী সম্মেলন বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার ফল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ভিত্তি-ভূমি নির্মাণের তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার অন্যতম।  

১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তবতা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো-টি নেই।  

মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ-সুকান্তের সমান্তরাল ব্যবহার ছিল চমৎকার শিক্ষা।  বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফীকে বলেন, 'শিল্পকলা একাডেমি করে দিলাম, লোকশিল্পসহ শিল্পকর্মের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করো। '

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

news24bd.tv নাজিম