এদেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা কেন ডাক্তার হবে?

এদেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা কেন ডাক্তার হবে?

কাজী তাহমিনা

ঘটনার দিন নামাজ এর সময়ে করিমন বিবি নামক রোগী নামাজ পড়তে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে হাসপাতালে আসেন। রোগীর সাথে তখন ৪/৫ জন ছিল। তাদের ব্যবহার তখনও ভালোই ছিল। বলাবাহুল্য, ঘড়ি না দেখলেও হয়ত ১ মিনিট এর ও কম সময়ে আমি এটেন্ড করি।

রোগীর তখন head swelling, gasping respiration, leg superficial trauma ছিল।  

রোগী দেখে মাত্রই অক্সিজেন লাগিয়ে দেয়া হয়। এর পরে ভিতরে রুমে এসে আমি যত তারাতারি সম্ভব চিকিৎসাপত্র লিখে দেই, রোগীর লোককে বলি আপনাদের রোগী কিন্তু খারাপ, যে কোন সময় উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ নেয়া লাগতে পারে। কারণ আমার মনে হচ্ছিল রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট দরকার।

হামলাকালীন যারা ছিল, তাদের কেউই তখন ছিলেন না।

রোগীকে নিয়ে তারা ওয়ার্ড এ চলে যায়। । তার প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পরে আমি দেখি তারা রোগীকে নিয়ে বিপুল জনগন নিয়ে চলে আসে। । আসার সাথে সাথে ই তারা দায়িত্বরত নার্স দের সাথে খারাপ আচরণ করা শুরু করে, কেন হাসপাতাল এর ওয়ার্ডে অক্সিজেন নাই, তার জন্য চিল্লাফাল্লা শুরু করে দেয়। । তাদের সাথে অশালীন ভাষায় কথা বলতে থাকে। ।

আমি এবার ও যথাসাধ্য চেষ্টা করি দ্রুত এটেন্ড করার। আমি আসার পরে আমাকে প্রথমে অশালীন ভাষায় গালি দেওয়া হয়। এর পরে একজন এসে আমাকে ধাক্কা মারে। আমি ধাক্কা সামলে উঠে রোগী দেখা শুরু করি। আর দায়িত্বরত নার্সকে বলি অন ডিউটি পুলিশ সদস্যদের খবর দিতে। তারা খবর পেয়ে আসেন। এর মধ্যে আমি সিপিআর দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু রোগী তার আগেই মারা যাওয়ায়, বস্তুত ওয়ার্ড থেকে দ্বিতীয়বার জরুরী বিভাগে আনার আগেই রোগী হয়ত মারা যান। কিছুতেই কিছু না হওয়া তে আমি আবার পিউপিল চেক করি। অক্সিজেন কিন্তু আসার সাথে সাথে ই তারা নিজেরাই লাগিয়ে নেন৷ 

এরপর তাদের একজন আমাকে সেখানেই বলে উঠে যে,,আজ আমার খবর আছে। রোগীকে যেম্নে পারি বাঁচাতে, নাইলে জিন্দা ফিরতে পারব না। এর মধ্যে পুলিশ এর ২ জন সদস্য চলে আসে। কিন্তু তাদের উপস্থিতিতেই আমাকে পেট এ লাথি মারা হয়। আমি তা সামলে নিয়ে পুনরায় রোগীর কাছে থাকি, পালস বিপি চেক করতে থাকি। এর মধ্যে তারা হাসপাতালের স্টেথোস্কোপ ভেংগে দেয়। আর রুম ভাংচুর তো আসার পর পর ই শুরু করে।

আমি পুলিশ কে বলি তারা ফোর্স নিয়ে আসতে। এত্ত লোক ছিল যে আমি ওখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একটু সুযোগ আসার পরে আমি বের হই। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বাইরে যাবার উপায় ছিল না। তখন তারা আমাকে না পেয়ে বলতে থাকে অই ডাক্তার কই, ওরে আজকে উঠায় নিয়ে জবাই করে ফেলব।  

এডিশনাল এস পি কে ফোন করি জানাই হামলা হচ্ছে। এরই মধ্যে আমার RMO sir কে জানাই। তাদেরকে জানানোর ৫ মিনিট এর মধ্যে পুলিশ ফোর্স চলে আসে। এর মধ্যেই তারা যখন আসে, তখন তাদের সামনে থেকে আমাকে তারা উঠিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। একজন পুলিশ সদস্য আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা এতবেশি ছিল যে, তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না আটকানো। আমি প্রাণপণে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু এদিকে আমার উপরে লাথির পর লাথি, ঘুষির পর ঘুষি আসতে থাকে। আমার চুল ধরে আমাকে ওয়ালে ঘশা খাওয়ানো হয়। আমার পেট এ পিঠে, মাথায়, ঘাড়ে, পায়ে লাথি, কিল ঘুষি চলতেই থাকে। তাদের মুখে ছিল মাইরা ফেলব ওরে আজ, মার, মার। ততক্ষনে জরুরি বিভাগের অন্যান্য স্টাফরা চলে আসে। তারা ও চেষ্টা করেন আমাকে বাঁচানোর। যদি আর ৩/৪ মিনিট এভাবে চলতে থাকত, আমি হয়তো স্পট ডেড হয়ে যেতাম। আমার ইন্টার্নরা ও তখন আমাকে বাঁচাতে এসে আহত হয়।

এরপরে আমাকে নিয়ে আমাদের রেস্ট রুমে রাখা হয়। স্টাফ রা আমার শুশ্রূষা করার ব্যবস্থা করেন। সত্যি বলতে ওই পুলিশ সদস্য যদি আমাকে না জড়িয়ে রাখতেন। আমাকে হয়ত ওরা উঠিয়ে নিয়ে যেত। আর মেরেও ফেলত।

এর কিছুক্ষণ পর আমার সম্মানিত ইউএইচএফপিও স্যার আসেন। উনি আমাকে অভয় দান করেন। পরে তিনি রুমের বাইরে চলে যান অন্যান্য স্যার দের নিয়ে। তার পরে তার সাথে ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখি নি। পুলিশ এর উক্ত কর্মকর্তার আচরণ শাস্তিযোগ্য।  

আমি এখন শারীরিক ভাবে অনেক অসুস্থ। জায়গায় জায়গায় ব্যথা আমার। আর চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই দুঃসহ ঘটনা, যখন আমাকে ২০-২৫ জন মিলে মারছে, উঠিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমি জানি না আমি কত দিন এ পারব এই দুঃস্বপ্ন ভুলতে।


আরও পড়ুন: অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাঈদীর অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো


আমি এই দুঃসময়ে আপনাদের সবাই কে পাশে চাই। আপনারা আছেন বলে আমি এখন ও টিকে আছি। বিশেষ করে বলতে হয় আমার স্ত্রীর কথা, সে আমাকে বুস্ট আপ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার পরিবার, শ্বশুরবাড়ি সবাই উৎকন্ঠায় আছে।

সবার কাছে এক্টাই চাওয়া আমার। এই ঘটনার যেন বিচার হয়। সারা দেশ এর সকল চিকিৎসক যেন নিরাপত্তা সহকারে সেবা দিতে পারেন৷। চিকিৎসক দের নিরাপত্তা চাই।

এই লেখাটা পড়ে মনে হলো, 'অরন্যে রোদন' একেই বলে!

এই দেশে মেধাবী পোলাপান কেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সৎ চাকরিজীবী হতে চাইবে?

ডাক্তার হলে পিটুনি খাবে। সৎ চাকরিজীবী ইঞ্জিনিয়ার হলে মারা পড়বে।
শুধুমাত্র ঘুষখোর, দুই নম্বর, তদ্বিরবাজ, সিস্টেমবাজ হলে সিস্টেমে টিকে যাবে- আর সিস্টেমের মধ্যে আবার যারা সৎ থাকতে চায়, তারাও পদে পদে মার/ মারা খাবে।

কাজী তাহমিনা: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (ফেইসবুক থেকে)

news24bd.tv আহমেদ