ফেসবুক নিয়ে সাতকাহন

ফেসবুক নিয়ে সাতকাহন

জসিম মল্লিক

১. ফেসবুকের ভাল দিক যেমন আছে মন্দ দিকও আছে। আনন্দের ব্যাপার যেমন আছে বিব্রতকর ব্যাপারও আছে। প্রত্যেকেই ফেসবুককে নানাভাবে ব্যবহার করে। সেটাই স্বভাবিক।

কেউ ফেসবুক লাইভ করে, কেউ বিজনেস করে, কেউ মজাদার সব খাবারের ছবি পোষ্ট করে, কেউ রাজনীতি করে, কেউ গল্প কবিতা লেখে, কেউ নিজের আঁকা ছবি পোষ্ট করে, কেউ সুন্দর সুন্দর পোশাক পড়ে, সুন্দর সেজে ছবি পোষ্ট করে, সেখানে এক লাইন দু ‘লাইনের আকর্ষনীয় কথা থাকে।  

অনেকের সন্তান, মা বাবা ,আত্মীয়, বন্ধুদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। ফেসবুক দুঃখের বার্তাও নিয়ে আসে, মৃত্যুর খবর, অসুস্থ্যতার খবর,আইসিউতে ভর্তির খবর থাকে। সাফল্যের খবর থাকে, জন্মদিন মৃত্যু দিবসগুলো জানতে পারি।

কষ্টের কথা থাকে, আনন্দের কথাও থাকে। প্রেম, পরিণয়, পরকীয়া থাকে। অনৈতিক ব্যাপার স্যাপারও ঘটে। মিথ্যা থাকে, ফাঁদ থাকে, বিপদ থাকে, প্রতারনা থাকে, অন্যকে হেয় করা থাকে। আবার অনেক অর্জণও থাকে। ফেসবুকে কি না থাকে! সবই থাকে।

আমিও ফেসবুকার। দিনের অনেকটা সময় চলে যায় ফেসবুকের পিছনে। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল হচ্ছে, মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক করছি। ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। সময় অপচয়ের জন্য মনোবেদনায় ভুগি। নিজর উপর রাগ হয়, বিরক্তি আসে। ফেসবুক ডিএক্টিভেট করি। কিন্তু আবার ফেসবুকের কাছে ফেরত আসি। এ এক কঠিন নেশা। কিছুতেই নেশা ছাড়ে না।  

আমার ছেলে মেয়ে ফেসবুক করে না। কেমন করে পারে জানি না। একদিন জেনে নেবো। আমি নিজের অনুভূতিগুলো সবসময় শেয়ার করি। লেখা পোষ্ট করি, সাথে ছবি থাকে। ফেসবুকের লেখা নিয়ে আমার এ পর্যন্ত সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাই ফেসবুকের সবটাই লস না, অর্জণও আছে।

ফেসবুকে লোক দেখানো ব্যাপারও থাকে, শো অফ থাকে, নিজেকে ভুলভাবে উপস্থাপন থাকে, প্রচুর মিথ্যা থাকে। অনেকে এসব লাইক করে, কমেন্টস করে। অনেকে লাইক কমেন্টস কিছুই করে না। হাই প্রোফাইলরা সাধারণদের ব্যাপারে নির্বিকার থাকে। তারা তাদের লেভেলের সাথে সখ্যতা করে। অনেকে আবার বুঝে বুঝে লাইক কমেন্টস করে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষের অবচেতনেই থাকে নানা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, দেখানেপনা। এ থেকে কেউই মুক্ত না, আমিও না। আমাকে নিয়ে কে কি ভাবে সেটা যেমন আমি বুঝতে পারি, আমিও অন্যের মনোভাব টের পাই।

২. এক সময় নিয়মিত পত্রিকায় লিখত এমন অনেকেই এখন আর লেখেন না। তারা ফেসবুকে লেখেন। আমিও আগের চেয়ে অনেক কম পত্রিকায় লেখার জন্য সময় দেই। ফেসবুক সংবাদপত্রের ভূমিকা পালন করছে। আগে যেমন ডাকবিভাগের মাধ্যমে হাতে লেখা চিঠির প্রচলন ছিল। এখন ইনবক্সে খবর আদান প্রদান হচ্ছে। ইনবক্সে লুকিয়ে আছে অনেক হাসি, কান্না, ব্যাক্তিগত গল্প। পত্রিকায় সংবাদ হওয়ার আগেই ফেসবুকের নিউজ ফীডে চলে আসছে।  

কখনো কখনো অতি উৎসাহীরা এডভান্স খবরও পরিবেশন করে, পরে দেখা যায় সেটা সঠিক না। গসিপ, পরচর্চা, পরনিন্দা এসবও ফেসবুকের নিয়মিত ঘটনা। ট্রল আর ভাইরাল হচ্ছে নানা ঘটনা, নানা মানুষ। কারো সামান্য ত্রুটি পেলেও ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষের অভাব নাই। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে, আন্দোলন, সংগ্রাম হয়েছে, সরকারের পতন পর্যন্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পতো টুইটার আর ফেসবুকের মাধ্যমেই চার বছর দেশ চালিয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের চেয়েও ফেসবুক পোষ্ট বেশি কার্যকর। বইমেলায় আমার ফেসবুক বন্ধুরাই আমার বইয়ের মূল ক্রেতা।

ফেসবুকে মিথ্যে প্রলোভনও আছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আছে। প্রেমের অভিনয় যেমন আছে, সত্যিকার প্রেমে পড়াও আছে, আলগা বন্ধুত্ব যেমন আছে আবার ভাল বন্ধুত্বও তৈরী হচ্ছে। গোপন সম্পর্ক যেমন আছে তেমনি আছে প্রকাশ্য সম্পর্ক। ফেসবুক গ্রুপ আছে, এডমিন আছে। অনেক লেখার গ্রুপে এডমিনরা নিজেদের রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সমকক্ষ মনে করে। যেনো তারাই লেখক তৈরী করেন। লেখক তৈরী হচ্ছেও।  

অনেক হালকা লেখায়ও হাজার হাজার লাইক পাওয়া যায়, আবার অনেক ভাল লেখায় বিশ তিরিশ জনে লাইক দিচ্ছে। একটু রগরগে লেখা, খোলামেলা ছবিতে বেশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষ। আবার রুচি স্নিগ্ধ ছবি বা ভাল লেখাগুলো মানুষ ঠিকই ভালবাসছে। ফেসবুকের কারণে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। পর নারী বা পর পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে, সংসার ভাঙছে অহ রহ। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের অনেকের সংসারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেপারেশন একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে যেনো। যাদের তারকা খ্যাতি আছে স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি বেশি ঝুঁকছে মানুষ। খ্যাতিমানরা নীল ব্যাজ পাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার তাদের। সুন্দর চেহারা, সুন্দর হাসি, সুন্দর পোশাক দেখেও অনেকে তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

৩. ফেসবুকের কল্যানে আমারও মজার মজার অভিজ্ঞতা আছে। দুটি ঘটনা বলি। বেশ কয়েক বছর আগে একজন ধনাঢ্য নারী এড করল আমাকে। সে একসময় আমার পেনফ্রেন্ড ছিল। দেখাও নাকি হয়েছে আমাদের। আমি অবশ্য কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। তারপর যথারীতি আমাদের কথা হয় ফেসবুকে। বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। সে আমাকে নানা আশ্বাস দেয়, স্বপ্ন দেখায়, আমি যা বলি তাতেই হ্যাঁ বলে। আমিতো মহা খুশী। নিজেকে গাড়ি, বাড়ির মালিক ভাবছি, উত্তরমুখী ঘরে বসে ধানমন্ডির লেক দেখব আর উপন্যাস লিখব এমন স্বপ্ন দেখছি। বিএমডব্লিউ নিয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে থাকবে, ঢাকা ক্লাবে ব্রেকফাষ্ট খেয়ে, চলে যাব মতিঝিলে নিজের অফিসে। তারপর একদিন সত্যি সেই স্বপ্নের বন্ধুর সাথে আমার দেখা হলো। প্রথম দেখা। আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাড়ির চাবিটা দেবে, ড্রাইভার এসে সালাম ঠুকবে, বলবে স্যার গাড়ি রেডি। প্রথম দিন একটা ক্যাফেতে আমরা কফি খেয়েছিলাম..।

দ্বিতীয় ঘটনাটা বলি। কয়েকমাস আগের ঘটনা। একজন খুব সুবেশি মেয়ে আমাকে ফেসবুকে এড করেছে। আমি তার প্রোফাইল ঘেটে দেখলাম সে আমেরিকায় থাকে। খুবই মড মেয়ে। বয়স পঁচিশ তিরিশ হবে। সাজু গুজু করা নানা পোজের ছবি। প্রতিটায় চমৎকার ইংরেজিতে এক দু লাইনের কথা থাকে। ছবিতে কড়া মেকাপ। প্রকৃত চেহারা হারিয়ে গেছে মেকাপের আড়ালে।


আরও পড়ুন: শীতের রাতের এক গ্লাস খেজুর রস, ফিরে গেলাম শৈশবে


স্যাক্সফিফথ এভিনিউ থেকে কেনা কসমেটিকস। সেসবের ছবিও আছে। আমি একটু বিভ্রান্ত, তাও তার রিকোয়েষ্ট একসেপ্ট করলাম। পরে জানলাম সে ঢাকায় জব করে। আমেরিকান কোম্পানীর জব। ভাল বেতন পায়। অনেক ভাল। সে আমাকে বলল, আমি দেখেছি আপনি বরিশালে একটা লাইব্ররি করতে চান। আমি আপনার পাশে আছি। আমাকে বাজেট দিলে আমি লাইব্রেরিটা করে দেবো।

আমি মহাখুশী। কৌতুহল বশত জানতে চাইলাম সে কেমন বেতন পায়। বলল পঞ্চাশ হাজার ইউএস ডলার।
আমি বললাম বছরে! সে বলল, না মাসে। আমি একটু ভিড়মি খেলাম। তবে বিশ্বাস করলাম।

তারপর দিন যায়, মাস যায়, প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমে। একদিন হঠাৎ চ্যারিটির নাম করে সে নিজেই আমার কাছে টাকা চেয়ে বসল। আমি আবার বিভ্রান্ত। আমি বললাম, আমি তো আমার মতো চ্যারিটি করি। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। এক পর্যায়ে আমি টাকা দিতে রাজী হলাম কিন্তু আমার মনে দ্বিধা হলো। আমি ঠিক টের পাই কোনটা সঠিক হবে কোনটা হবে না। এসব কারনে আমি অনেক ঝামেলা থেকে রক্ষা পাই।

৪. ফেসবুকের সবচেয়ে ব্রিবতকর যেটা সেটা হচ্ছে কেউ কেউ রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েই আর্থিক সাহায্য চায়। ফিচকা মেয়েরাই বেশি টাকা চায়। অনেকের সত্যি সাহায্যের দরকার আছে। কেউ কেউ প্রতিষ্ঠানের জন্য ডোনেশন চায়, কেউ অসুস্থ্যতায় চিকিৎসার জন্য চায়। কেউ অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে টাকা চায়। যতটা সম্ভব আমি সাহায্য করিও, ডোনেশন দেই। কিন্ত সবসময় পারা সম্ভব হয় না। কিন্তু যখনই কাউকে সাহায্য করতে অপারগ হই তখনই বন্ধুত্ব ছুটে যায়। আনফ্রেন্ড করে আমাকে। আমি নিজে থেকেও আনফ্রেন্ড করি। ফেসবুকের ভাল দিক যেমন আছে আবার বিব্রতকর ঘটনাও আছে। এটাই জীবন।

লেখক, সাংবাদিক, কানাডা

news24bd.tv আহমেদ