কেমন গেল ‘বিষের বছর’ ২০২০

কেমন গেল ‘বিষের বছর’ ২০২০

সাদিয়া নাসরিন

১. অনেক মৃত্যু, দু:খ, বিরহ, দহন সব নিয়েও শেষ অবধি সন্তান, সংসার, কাজ সব নিয়ে ধনধান্য কর্ম প্রাণ প্রাচুর্য ভরা রাজহংসীর একটা জীবন আমি কাটিয়েছি এ বছর। সাধ্যমতো পরিশ্রম করেছি, দুহাতে কাজ করেছি, জীবন চারহাতে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। “আমি অকৃতি অধম বলে কিছু কম তো মোরে দাওনি, যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি!" 

২. এটি এমন একটি বছর যার গল্প লিখতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর সার্ভারে হঠাৎ করোনা নামের হ্যাকার ঢুকে যখন একে তচনচ করে দিচ্ছিলো মানুষের সাজানো গ্রাম, থেমে গিয়েছিলো পুরো বিশ্ব, সেই সময়টাতে, ঠিক সেই সময়টাতে আমি এবং আমার পরিবার আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলাম।

আমার সন্তানরা তাদের ছোট ছোট হাত প্রসারিত করেছিলো মানুষের দিকে। এই গল্প জীবনের।  

৩. চারপাশের মৃত্যুসাগর সাঁতরে জীবনের তীরে পতাকা ওড়ানোর বছর ছিলো আমাদের। বাইরের আতঙ্ক থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে ঘরকে কী করে আনন্দ নিকেতন বানিয়ে রাখা যায় সেটি শিখেছি আমরা সবাই মিলে।

আমরা হেসেছি, গেয়েছি, নেচেছি, আমরা পরষ্পরের আরো কাছে এসেছি। বাইরের ফাঁপা সার্কেল, অযোগ্য সঙ্গ, অযথা সামাজিকতা এসব যে কতটুকু অপ্রয়োজনীয় সেই মহান শিখন আমরা সকলেই গ্রহণ করেছি।  

৪. আমার আব্বা, আমার বটবৃক্ষটা দুর্বল হয়ে গেলো এবছর। আব্বা স্ট্রোক করার পরে আমার সবচে বড় ধাক্কাটা হলো আব্বাকে ছাড়া আমি কী করে সার্ভাইব করবো সেটা ঠিক করা। যতো চেষ্টা করেছি ততো ভয় পেয়েছি, আবার যতো ভয় পেয়েছি ততো সাহস করে পথ খুঁজেছি। যেহেতু গাছটিই দুর্বল হয়েছে, তাই ছায়ার আশা কমিয়ে রোদ বৃষ্টির সাথে কোঅপ করেছি।  

৫. জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর, তীব্র ডিপ্রেশনে তিনটা মাস জীবন থেকে ‘নেই’ হয়ে গেলো এই বছর। দুহাজার আঠারোতে একবার চারমাসের আয়ুক্ষয়ী বিষাদ আমাকে নিংড়ে নিয়েছিলো। বিশ এর বিষাদ সেভাবে শেষ করতে পারেনি, তবে ক্লান্ত হয়েছি এবার খুব। এই বিষাদক্লান্তি  আমাকে বড় করেছে, শান্ত করেছে, স্থির করেছে। এই বিষাদগ্রস্ত সময়ে আমি জীবন রাঙানোর শক্তি থেকে মৃত্যু রাঙানোর স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। এই স্বপ্ন অন্যরকম শিহরণ জাগায় শরীরে এবং মনে।  

৬. সেই স্বপ্নের জোরেই তীব্র বিষাদের সাথে লড়তে লড়তেও কাজ করেছি, বেঁচেছি। এবং বেঁচেছি বলেই নতুন করে বলতে পেরেছি, মানুষকে জীবনে ধ্বংস করা যায়, পরাজিত করা যায়না। শেষ অবধি শান্ত মাথায়, সঠিক কৌশলে ময়দানেই থাকতে পেরেছিলাম বলেই বলেই আজও জীবনের গল্পটা আমিই বলতে পারি। লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকাটাই মূল যুদ্ধ। আমি টিকে ছিলাম।  

তবে এরকম বছরের কথা যতোবার বলবো ততোবার আমাকে বলতে হবে তার আগের তিনবছর ধরে খাদের কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওঠে দাঁড়ানোর দিনগুলোর কথা।  

- ২০১৭ তে, আমি যে বড় পরিবারের বড় মেয়ে, সেই বড় পরিবারের বড় বড় সব পুরুষরা, যারা আমার বাবার ভাই বলে জেনে বড় হয়েছি আমি, একজোট হয়ে যে মরণ আঘাত হেনেছিলো  আমার উপরে, বড় বাড়ির বড় মেয়েটির মাথা আকাশের দিকে ওঠে যাচ্ছিলো বলে সেই মাথা বরাবর ছুঁড়ে দিয়েছিলো জালিয়াতি আর হয়রানির ছুরি, তাতেই আমার মাথা কাটা পড়ে, আমারই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।  

কিন্তু আমি শেষ হইনি। আমাকে আসলে এভাবে শেষ করা যায়না। মিথ্যা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সত্যকে আড়াল করা যায়না। তবে আমি ভেঙেছি। আমি দেখেছি একজন মেয়েকে মোকাবেলা করার জন্য ছয়জন পুরুষকে ভাড়াতে খেলোয়াড় নিয়েও শেষ অবধি মিথ্যা আর জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হয়। এইসব অক্ষম, অমেরুদণ্ডী কেঁচোগুলো আমারই রক্ত!!!! আমার বাবারই ভাই!!!! আমি এদের পরিচয় অগ্রাহ্য করতে শিখেছি।  
#সুখ:
“মা, ডোন্ট ক্রাই, এভরিথিং উইল বি ফাইন সুন”—-ছোট ছোট হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেছিলো যামীম।
#অসুখ
“মা, আমি স্কুলে যেতে চাই। আয়্যাম বোরড উইদ দিস অনলাইন ক্লাসেস। আই মিস মাই ফ্রেন্ডস”——-পৃথিবীর সব শিশুদের হয়েই এই কথা বলেছিলো যামীম 
#প্রাপ্তি: 
-আমাদের আনন্দময় নিয়াশ।  
-ছায়াময় বকুলবাগান।  
-মানুষের দুর্যোগে, মানুষের পাশে থাকার অমূল্য সুযোগ।  
#অপ্রাপ্তি: 
কিছুই নেই। যা পাইনি তা আমার ছিলোইনা। যা হারিয়েছি তা হারানোরই ছিলো।  
#অভিজ্ঞতা: 
এই পৃথবীতে প্রতারকের অনেক ধরণ আছে, যারা সন্তানের নামে কসম কেটেও মিথ্যা বলে। আবারও জেনেছি এসব প্রতারকদের জন্য আমার নিজের পাশের বিশ্বাসঘাতক বন্ধুরাই কাজ করে।
#শিখন: 
-উপেক্ষার চেয়ে বড়ো শক্তি নেই, সাহসের চেয়ে শাণিত অস্ত্র নেই, নিজের চেয়ে ভালো সঙ্গী নেই।  
-যে কোন সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ আসলেই সব শেষ হয়ে যায়। এবং মানুষ কোনভাবেই কোন সুন্দর সম্পর্ক সহ্য করতে পারেনা।
-যে যতটুকু অপরাধ করে, তাকে ততটুকু শাস্তি অবশ্যই দিতে হয়। এটা খুব জরূরী।  
#মূলধন: 
: উপেক্ষার শক্তি, বর্জনের সাহস ও দায়মুক্তির ক্ষমতা
: লড়াই, ক্ষরণ ও অভিজ্ঞতা 
: কুড়িয়ে পাওয়া ভালোবাসা আর মানুষের দোয়া।  

নতুন একটা বছর কড়া নাড়ছে। দরজাটা খুলতে হবে। ওপারে জীবন। জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই।  
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ভালোবাসায় থাকুন, ভালোবাসায় বাঁচুন। ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি নেই।

(সাদিয়া নাসরিন, উন্নয়ন কর্মী)

news24bd.tv তৌহিদ