সম্পদের নেশা

সম্পদের নেশা

Other

লোকটির নেশা ছিল সম্পদ আহরণে। প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ-কালাম পড়েই ঘুরাঘুরি করত নিজের গড়ে তোলা সম্পদের আশেপাশে। আল্লাহকে সে ডাকত সকাল সন্ধ্যা। তার মোনাজাতের বড় অংশ জুড়ে থাকত সম্পদ হেফাজতের প্রার্থনা।

 

সম্পদের মোহে কোথাও সে বেড়াতেও যায় না। একবার পাড়া প্রতিবেশীর পীড়াপীড়িতে সে হজ্জে গিয়েছিল। কাবা শরীফ তওয়াফ করার পর সে মোনাজাতে বসে। সেখানেও কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে সম্পদ হেফাজতের কাতর প্রার্থনা করেছিল।

 

একদিন তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্পদ ত্যাগ করতে চেয়েছিল সে। আর ঠিক সে সময়েই শুরু হয় সামাজিক বিদ্রোহ। গ্রামের ছিন্নমূল নিঃস্বরা শহর দখল করতে ছুটে আসে। শহরের আইন-শৃঙ্খলা বলতে আর কিছু থাকে না।  

মধ্যযুগের দার্শনিক ইবনে খালদুন প্রথম এই সামাজিক বিপর্যয়ের কথা বলেছিলেন। পরবর্তীকালের দার্শনিক মার্কস এবং এঙ্গেলস ইবনে খালদুনের দার্শনিক সিদ্ধান্তকে শ্রেণী সংগ্রামের ফলাফল বলে তাদের মত রেখে গেছেন।  

বিদ্রোহ যাতে না ঘটে, সে জন্য ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত বই আল মোক্বাদ্দিমায় সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছিলেন। এর নাম “আসাবিয়াহ”! 

অনেকে নানা বিষয়ে ধর্মকে টানেন। কারণ প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলো প্রায় সব বিষয়েই কথা বলেছে। ইসলাম ধর্মও বলেছে সম্পদের বিষয়ে। হযরত মুহাম্মদকে যখন প্রশ্ন করা হলো মু’মিনের সবচেয়ে বড় সম্পদ কী? উত্তরে তিনি বলেছেন- “ঈমান”! 

ঈমানের বাংলা প্রতিশব্দ বিশ্বাস। একজন সাহাবা ইবনে মাযহা বলেছেন- ‘ঈমান ছাড়া বাকি সব আমলই আল্লাহর কাছে মূল্যহীন। ’ অথচ আমাদের আলেম-ওলামারা তাদের ওয়াজ নসিহতে ঈমান সম্পর্কে খুব সামান্যই কথা বলেন। কারণ সমাজের উচ্চ বিত্তদের চটাতে চান না তারা।  

সম্পদের নেশা মানুষকে নানা পথে পরিচালিত করে। কেউ সোজা পথে সম্পদ অর্জন করেছে, ইতিহাসে এমন মানুষ আদৌ আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু খালি চোখে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব কিংবা সমাজে সম্পদ সংগ্রহের যে প্রয়াস দেখি, সেটা সোজা পথে নয় মোটেও।  

সম্পদ সংগ্রহে মানুষ প্রথমে ঠকায় নিকটজনকে। নিকটজনকে ঠকিয়ে প্রথমে হাত পাকায়। তারপর ধীরে ধীরে অগ্রসর হয় অপরকে ঠকানোর দিকে। মানুষকে ঠকানোর জন্য ঠগদের নানা মুখোশ পরতে হয়। ধর্ম ও রাজনীতির মুখোশ এ ক্ষেত্রে অন্যতম।  

আকাশ সংস্কৃতির যুগে নানা ক্ষেত্রে মানুষের জেল্লা বাড়ছে। ব্যবসার পসার হচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়া দেখে বুঝতে পারি গ্রহ-নক্ষত্রের নামে পাথর বিক্রির ব্যবসা সেখানে কতটা রমরমা! পীর, সাঁই বাবাজীদের ব্যবসাও বাড়ছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে ওয়াজিয়ানদের হেলিকপ্টারে চলাফেরায় আন্দাজ করা যায় রাজনীতিবিদদের টেক্কা দিতে তারাও মরিয়া!

কেউ কেউ বলেন ঈমানের আরেক নাম “ইয়াক্বীন”, যথার্থ। এরও বাংলা প্রতিশব্দ বিশ্বাস। “বিশ্বাসে মিলায় ভগবান, তর্কে বহুদূর” এমন প্রবাদ ভারতীয় নীতিশাস্ত্রেও আছে। মু’মিনের কাছে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো ‘ইয়াক্বিন বা পরিপূর্ণ বিশ্বাস’ অর্জন করা।  


যে দোয়া পড়লে কখনো বিফলে যায় না!

যে সময় দোয়া পড়লে দ্রুত কবুল হয়

কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে যে দোয়া পড়বেন!

যাদের দোয়া দ্রুত কবুল হয়


দৈনন্দিন কাজকর্মে (ইবাদাত-বন্দেগিতে) শুধুমাত্র আল্লাহর ধ্যান-জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা চেতনা থাকবে না। তাহলে আল্লাহতে যার পরিপূর্ণ বিশ্বাস, তিনি কি সম্পদের নেশা করতে পারেন? তিনি কি ছুটতে পারেন সম্পদের পেছনে?

আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, সেই প্রকৃত মু’মিন। প্রকৃত মু’মিনের কখনো সম্পদের নেশা থাকতে পারে না। কবি নজরুল তাই আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান।
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু-জ্ঞান!”

তাহলে- মানুষের জীবনে কতটুকু সম্পদের প্রয়োজন? আমার এক শিক্ষককে এ প্রশ্ন করেছিলাম একদিন। উত্তরে আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেছিলেন- “কালকে বাঁচলে খাইতাম কিতা, আর মরলে খাইত কেডা?” 

তারমানে বেঁচে থাকার মত প্রয়োজনীয় উপায় থাকলেই হলো! মৃত্যুর পর তোমার উত্তরসূরিরা কি খাবে না খাবে, সেটা উপরওয়ালার হাতেই ছেড়ে দাও!

হযরত মুহাম্মদ বলেছেন- “তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো যেন তুমি তাকে (আল্লাহকে) দেখছো। আর যদি তুমি তাকে দেখতে না পাও, তবে একথা বিশ্বাস রাখ যে, তিনি তোমাকে দেখছেন!” 

তাহলে যারা সম্পদের নেশায় ওপরকে ঠকানোর মতলব করে, তারা কি কখনো আল্লাহর দরশন লাভের চেষ্টা করে?

যারা সম্পদের নেশা করে, তারা কখনো জান্নাতে (স্বর্গে) যাবে কি-না এ নিয়ে পরিস্কার করে হযরত মুহাম্মদ বলেছেন- মু’মিনের কাছে কোন জীবনটা সবচেয়ে মূল্যবান? যে জীবন অনন্ত! অর্থাৎ পরকাল। তাহলে ক্ষণস্থায়ী জীবনের লোভ লালসায় মু’মিন কেন মগ্ন হবে? 

কোরআনের সুরা বাকারায় বলা হয়েছে- “আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, মহামারি এবং সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। এমন বিপদগ্রস্ত অবস্থায় যারা ধৈর্য ধারণ করবে, তাদের সুসংবাদ দাও!”  

কিন্তু সম্পদের নেশাগ্রস্তরা কি ধৈর্য ধারণ করে? নেশার কোনো রকম-ফের নেই। মদ্যপ লোকটির কাছে যেমন রাত-দিন, সময়-অসময়ের জ্ঞান নেই, তেমনি সম্পদের নেশাগ্রস্তও পাপ-পুণ্যের বিচার করে না। যে কোনো প্রকারে, যে কোনো সময় সম্পদ আহরণই তার কাছে মূখ্য।

এটাই সৃষ্টির রহস্য। সম্পদের নেশায় মানুষ রাতের ঘুম হারাম করে। যা মদের নেশার চেয়েও ভয়াবহ। তারপরও নেশা ছাড়তে পারে না! অপরের কাছে এক টাকা ঠকলে, ক্ষতি পোষাতে আরেকজনকে দুই টাকা ঠকানোর কৌশলে লিপ্ত হয়! 

আমার আত্মীয় মতন সত্তুরোর্ধ এক ব্যক্তিকে আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনার মধ্যে সম্পদের এত নেশা কেন? উত্তরে ঐ ব্যক্তিটি বলেছিলেন- “আমি অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়েছি। সারা জীবন আমি খেয়ে না খেয়ে সম্পদের পিছু ছুটেছি। এখন আমি চাই যে, আমার সন্তানরা যেন কখনো দারিদ্রের মুখোমুখি না হয়!”

প্রশ্ন করেছিলাম- আপনি কি কখনো সন্তানদের পরিশ্রম করতে দেবেন না? তাহলে তো কখনো তারা সম্পদ সংগ্রহের কষ্ট অনুভব করবে না! বরং ঐ সম্পদটাই তাদের জন্য জীবন যন্ত্রণার কারণ হতে পারে! ভদ্রলোক এর কোনো জবাব দিতে পারেননি।  

আর এক আত্মীয়মত মতলববাজ প্রায়ই আমার স্ত্রীকে নসিহত করে- “স্ত্রী যেন আমাকে নামাজী বানায়!” আজ জানলাম- ঐ মতলববাজ লোকটিই তার কাছে জমা থাকা আরেক আত্মীয়ের এক লাখ ডলারের আমানত খেয়ানত করে ফেলেছে।  

ঐ আত্মীয়মতন লোকটির কি একবারও মনে পডলো না সেই বিখ্যাত হাদিস- “আমানতের খেয়।

news24bd.tv / আয়শা

 

 

এই রকম আরও টপিক