ঐতিহ্য হারাচ্ছে মাদারীপুরের খেজুর গুড়

ঐতিহ্য হারাচ্ছে মাদারীপুরের খেজুর গুড়

Other

আদিকাল থেকেই মাদারীপুরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল খেজুরের গুড়। তবে এ ঐতিহ্য এখন অনেকটাই  হারিয়ে যাওয়ার পথে। ‘খেজুর রস-খেজুর গুড় দক্ষিণের দ্বার মাদারীপুর’। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন এ স্লোগানকেই ব্রান্ডিং করেছে ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস ও গুড়ের কারণে।

সেই খেজুর গুড়ের বাজার জমে উঠেছে মাদারীপুর শহর, গ্রাম তথা বড় বড় হাট বাজারে। ঐতিহ্যের কদর করেই এখনো তৈরি গুড়।  

news24bd.tv

বাণিজ্যিকভাবে অঞ্চল ভিত্তিক খেজুরের রস ও গুড়ের রপ্তানি না হলেও চাহিদা রয়েছে এখনও। এ অঞ্চলের পাটালি গুড় ভাঙলে কাচা রসের গন্ধ এবং লাল-খয়েরী স্ফটিকের মতো রঙ আর অতুলনীয় স্বাদ পাওয়া যায়।

তবে আগের মত রস না থাকায় চড়া দামেই বিক্রি হয় রস ও গুড়। তবে মাদারীপুুরের এই খেজুরের রস ও গুড়ের ঐতিহ্য যাতে হারিয়ে না যায় এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে হয়তো ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এখানকার রস ও গুড় শুধুই যে স্থানীয় চাহিদা মেটায় তা কিন্তু না।  

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাদারীপুুরের প্রায় সব উপজেলায়ই গুড় কম-বেশি পাওয়া যায়, তবে খোয়াজপুর, মস্তফাপুর, কালিকাপুর, কুনিয়া, আমগ্রাম, বাজিতপুর, বদরপাশা, কবিরাজপুর, লক্ষীপুর, রমজানপুর, সাহেবরামপুর, উমেদপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে গুড় পাওয়া যায়। মাদারীপুর শহরের পুরান কোর্ট এলাকায় গুড়ের বাজার বেশ জমে উঠে প্রতিবছরই। আশ পাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে গুড় কিনতে আসে ক্রেতারা। অনেক সময় চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে গুড় নিতে দেখা যায় অন্য জেলা লোকদের।

news24bd.tv

প্রতিদিন বিকেলে গাছ কাটায় (রস বের করার পদ্ধতি) ব্যস্ত থাকে শেয়ালিরা (গাছি)। খুব ভোরে গাছি ও তার পরিবারের সদস্যরা গাছ থেকে রস নামিয়ে সেই রস জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু গুড়। আগুনের আঁচে ধীরে ধীরে সোনালী, কমলা অবশেষ রক্তিম লাল হয় গুড়ের রং। তখন এ তরল গুড় দিয়ে বেশ কয়েকটি নামের গুড় তৈরি করা হয়। যেমন ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, খানডা গুড়, নলের গুড়।  

হাট-বাজার দেখা যায়, গুড়ের দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। মৌসুমের শুরুতে তেমন গুড়ের দাম ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে কেজিতে বিক্রি হয় এই গুড়। তবে বেশি দামের যে গুড় বিক্রি হয় তার মান ও স্বাদ বেশি ভাল।

মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমান ছিল ৫০ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৬৪৮০০, রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১৯৭২৫, রস সংগ্রহ করে এমন গাছির সংখ্যা ছিল ৫১৫ জন, খেজুর গুড় উৎপাদন ছিল ২৪০ মে.টন, সম্ভাব্য গুড়ের চাহিদা ছিল ৬২৩ মে.টন।  

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমান ছিল ৪৪.৫ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৫৭২৫০, রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১৭০২৫, রস সংগ্রহ করে এমন গাছির সংখ্যা ছিল ৪৯০ জন, খেজুর গুড় উৎপাদন ছিল ২২৬ মে.টন, সম্ভাব্য গুড়ের চাহিদা ছিল ৬১৭ মে.টন।  news24bd.tv

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমান ছিল ৪১.৭৫ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৪৭,৪০০,রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১৩৫৭৫, রস সংগ্রহ করে এমন গাছির সংখ্যা ছিল ৩৫৫ জন, খেজুর গুড় উৎপাদন ছিল ১৯১ মে.টন,সম্ভাব্য গুড়ের চাহিদা ছিল ৬১৭ মে.টন।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমান ছিল ৪০ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৪৫৫৫০, রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১২,৭০০, রস সংগ্রহ করে এমন গাছির সংখ্যা ছিল ৩১৫ জন, খেজুর গুড় উৎপাদন ছিল ২০৪ মে.টন,সম্ভাব্য গুড়ের চাহিদা ছিল ৬১২ মে.টন।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে খেজুর গাছের সম্ভাব্য আবাদকৃত জমির পরিমান ছিল ৩৪ হেক্টর, খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৪০৭০০, রস বা সংগ্রহ করা হয় এমন গাছের সংখ্যা ছিল ১২,২১০, রস সংগ্রহ করে এমন গাছির সংখ্যা ছিল ৩০৬ জন, খেজুর গুড় উৎপাদন ছিল ১৮৩ মে.টন,সম্ভাব্য গুড়ের চাহিদা ছিল ৬৩০ মে.টন।

আরও পড়ুন:

রাজধানীর যে সব এলাকায় কাল গ্যাস থাকবে না

এরফান সেলিমকে অব্যাহতি দিয়ে রিপোর্ট জমা

বিয়ের ৭০ দিনে সন্তান প্রসব, দুপুরে তালাকের পর রাতেই প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে


মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর এলাকার শেয়ালী (গাছি)  লাল চান বেপারী বলেন, প্রায় ২০ বছর যাবৎ গাছ কাটি ও গুড় বানাই। খাটি গুড় বিক্রি করি বেশি দামে, আমার গুড় শুধু এই এলাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশেও যায়। বেশির ভাগ সময়ই গুড় বানানোর জন্য অর্ডার আসে। এ সময় আমার ব্যস্ততা বেশি থাকে। আর গুড় তৈরি করতে অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়। গাছ কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মত বেশি রস পাই না। গাছের মালিকের সাথে পালা করে রস নিতে হয় বেশিরভাগ সময়ই। একদিন গাছের মালিক নেয় আরেকদিন আমি। আগে আমরা একজন গাছি ২০-৩০টা খেজুরের গাছ কাটতাম, এখন ৬-৮টা গাছ কাটি।

পুরান কোর্ট এলাকার গুড় বিক্রেতা আব্দুল মান্নান বলেন, এখানে গুড় কিনতে অনেক ক্রেতা আসে। সবাই খাঁটি গুড় চায়। অনেকে টাকার দিকে তাকায় না। তারা খাঁটি গুড় চায়। অনেকে মোটামুটি দামের গুড় নেয়। আমরা যেমন দাম দিয়ে কিনি তেমন দামেই বিক্রি করি।  

আরেক গুড় ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, খাটি গুড় পাওয়া কঠিন। ভাল দাম পেলে খাটি গুড় দেয়া যায়। তবে গাছ অনেক কমে গেছে। মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, খেজুর গুড়ের মান ভাল করার জন্য আমরা গুড় প্রস্তুতকারীদের সাথে আলোচনা করেছি। আর খেজুর গাছের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য হরর্টিকালচার সেন্টারকে ১০ হাজার চারা গাছের অর্ডার দিয়েছি। আমরা মাদারীপুরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় সচেষ্ট আছি।  

news24bd.tv / কামরুল