‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কথাটি কেন বলি?

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কথাটি কেন বলি?

Other

সরকারি-বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোতে তৃতীয় লিঙ্গ অহরহ কথাটি ব্যবহৃত হয়। আমরা জনমানুষও এই শব্দটি ব্যবহারে অপ্রয়োজন দেখি না! এমনকি যারা জেন্ডার বৈচিত্র‍্যময় আইডেন্টিটির অধিকারী তারাও এই শব্দ চয়ন করে থাকেন। কিন্তু সত্যিই কি এই শব্দ ব্যবহারে আমরা সমস্যা দেখি না?

গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসায় সয়লাব হয়েছিল, তৃতীয় লিঙ্গের ভারতীয় ভি এস প্রিয়া ডাক্তার হয়েছেন! কিন্তু কোনো নারী বা পুরুষ যদি এই ক্ষেত্রে প্রথম এরকম কিছু করতেন আমরা কী লিখতাম, দ্বিতীয় লিঙ্গের কেউ প্রথম এই কাজ করল বা প্রথম লিঙ্গের কেউ একজন এই কাজটি করল? লিখতাম না নিশ্চয়ই!

কারণ নারী পুরুষের সহজাত জেন্ডার আইডেন্টিটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করলেও, আমরা ইতস্তত হই এর বাইরের কোনো জেন্ডার আইডেন্টিটিতে। তাই আমরা নারী-পুরুষের বাইরে অন্য যেকোনো জেন্ডার আইডেন্টিটিকে একত্রে তৃতীয় লিঙ্গ বলে ফেলি! এই সরলীকরণ করা মানে, সব জেন্ডার বৈচিত্র‍্যের আলাদা আলাদা সংজ্ঞাকে নালিফাইড করে দেওয়া।

শুধু তাই নয়,এই তৃতীয় কথার মাধ্যমে আমরা স্বীকার করে নেই, প্রথম এবং দ্বিতীয় আছে। অবধারিতভাবে জেন্ডার হায়ার্কি আছে। জেন্ডার সমতার লড়াই করতে গিয়ে আগেই আমরা বলে দিচ্ছ পুরুষ প্রথম! হায়ার্কি মেনে নিয়ে কি সমতা করতে চাচ্ছি???

ভি এস প্রিয়া একজন ট্রান্স উইম্যান। জেন্ডারের দুই ধরণ নিয়া আমরা কথা বলি।

একটি সিস জেন্ডার এবং অন্যটি ট্রান্স জেন্ডার।

জেন্ডার এবং সেক্স আলাদা বিষয়। সেক্সকে বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি বলে এবং জেন্ডারকে বলা হয় সামাজিক আইডেন্টিটি। পুরুষাঙ্গ এবং স্ত্রী অঙ্গ থাকা প্রাকৃতিক এবং বায়োলজিক্যাল। কিন্তু পুরুষ অঙ্গ থাকলেই কাউকে শার্ট পরতে হবে, শক্তিশালী হতে হবে, এই বিষয়টা সমাজের তৈরি। এইটা হচ্ছে জেন্ডার। যারা নিজেদের বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি মোতাবেক সোশ্যাল আইডেন্টিটিকে গ্রহণ করে তারা সিস জেন্ডার। আর যারা সেইটা করে না, ট্রান্সফরমেশন করে, তারা ট্রান্স জেন্ডার।

ট্রান্স উইম্যান, পুরুষের বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি নিয়ে জন্মালেও নারীর সামাজিক আইডেন্টিটি গ্রহণ করে। ট্রান্স ম্যানের বিষয়টি এর উল্টো। অর্থাৎ নারীর শরীর নিয়ে জন্ম নিয়ে পুরুষের সামাজিক যে আইডেন্টিটি তা গ্রহণ করে। বাংলায় আমরা রুপান্তরকামী নারী বা পুরুষ বলি। অর্থাৎ তারা রুপান্তর নারী বা পুরুষ হবার কামনা করছে।   

যারা এস আর এস বা সেকজুয়াল রিএসাইনমেন্ট সার্জারি করে, হরমোন ট্রিটমেন্ট করে পুরোপুরি নিজেদের জেনেটিয়াল অঙ্গগুলোকে প্রতিস্থাপন করে বা অপসারণ করে, তখন তাদের আমরা ট্রান্সসেকজুয়াল উইম্যান বা ম্যান বলি। বাংলায় বলি রুপান্তরিত নারী বা পুরুষ।

তাস খেলে বরখাস্ত হলেন ৯ পুলিশ সদস্য

সেই কবরটির একপাশে লেখা ইয়াসিন, অন্যপাশে মিম হা মিম

ইন্টারসেক্স হচ্ছে অন্তবর্তীলিঙ্গ। অর্থাৎ দুই ধরনের বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি বা আংশিক আইডেন্টিটি নিয়ে যারা জন্মায় এবং নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী জেন্ডার রোল বেছে নেয় তাদের ইন্টারসেক্স বলছি।

এবার আসি, আরেকটা ভুলে! আমরা ট্রান্সউইম্যান, ট্রান্সম্যান, ইন্টারসেক্স, সবাইকে যেমন তৃতীয় লিঙ্গ বলে দেই! তেমনি আরেকটা জিনিস বলি, সেইটা হচ্ছে হিজড়া।

হিজড়া একটি কমিউনিটি৷ তাদের নিজস্ব কালচার আছে। গুরুমা আছে। দীক্ষা আছে। বাউলদের মতো হিজড়াদের নিজস্ব জীবনাচারণ আছে। সব ট্রান্সউইম্যান বা ইন্টারসেক্স  মাত্রই হিজড়া না। বেশিরভাগ ট্রান্সউইম্যান বা ইন্টারসেক্স অন্য পেশা বেছে নেয়। সবাই হিজড়া হয় না। তবে সব হিজড়াই ট্রান্সউইম্যান বা ইন্টারসেক্সের আওতায়।

ভি এস প্রিয়া আদৌ হিজড়া কমিউনিটি থেকে উঠে এসেছে কিনা আমরা জানি না! তাই তাকে হিজড়া বলাও যুক্তিসংগত না।

আশ্চর্য যে, এত জেন্ডার বৈচিত্র‍্যকে আমরা কর্নার করে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া বলে একত্রীকরণ করতে চাচ্ছি। তাদের বৈচিত্র‍্যতাকে মাথাতেই নিচ্ছি না। অবধারিত ভাবে তাদের বৈচিত্র‍্যতাকে 'তৃতীয়' বলে পুরুষ ও নারীর চাইতে অধস্তন করছি।  

দ্যাখেন সরকারি দস্তাবেজে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং তৃতীয় লিংগ দুইটা শব্দের ব্যবহারের ফেনোমেনা একই। ঊর্ধ্বতন অধিস্তনের রাজনীতি। কিন্তু আমাদের তো আসলটা জানতে হবে। এই নিয়ে আলাপ তো উঠাতে হবে।  

তো, আমরা গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং নিজেদের সাংগঠনিক দলিল দস্তাবেজে তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি পরিহার করার চেষ্টা জারি রাখি। সঠিক শব্দ দিয়ে সঠিক জেন্ডার আইডেন্টিটিকে তুলে ধরি।

লেখক-  ‌‘নারী অধিকার কর্মী’ মারজিয়া প্রভা

news24bd.tvতৌহিদ