ঐশি, মুগ্ধ এবং দিহানেরা, আমাদের দায় না কর্মফল?

ঐশি, মুগ্ধ এবং দিহানেরা, আমাদের দায় না কর্মফল?

Other

সেই একই শিরোনাম, ঐশী রহমান, ফারদিন হুদা মুগ্ধ বা আজকের ফারদিন ইফতেখার দিহান। ঐশি থেকে দিহান। সতেরো আঠারো বছরের জীবনগুলো সব। কারা ওরা ? আমাদের সন্তান? যে সন্তানের সাথে আমাদের বন্ধ দরজার কঠিন আড়াল? সে আড়ালের ওপাশে হয়তো কেউ বুঁদ হয়ে আছে নেশার নীলে, কেউ মেতে উঠেছে ধর্মান্ধ জঙ্গি রাজনীতির রক্তখেলায়, আবার কেউ অনলাইনের পাশবিক যৌন উল্লাসে জীবন বিকোচ্ছে।

 

গাঁজার ধোঁয়া, ইয়াবার ফয়েল কিংবা ধর্মের আফিম কিংবা যৌনতার পাশবিক নেশায় নীল হয়ে যাওয়া কিশোর, কারা ওরা? আমাদের কর্মফল নয় তো ? 

আজ থেকে সাত বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল সতের বছরের ঐশি। ইয়াবা আসক্ত ঐশি মা বাবা দুজনকে খুন করেছিলো। ঐশির বাবা ছোট্ট একটি চাকরি করতো। যা বেতন তা দিয়ে বাড়ি ভাড়াও হয় না।

অর্থ না থাকার দুঃখ ছিল ঐশির মায়ের। বাবা ছুটেছেন অবৈধ অর্থের পেছনে। মা ব্যস্ত ছিলেন অর্থ বিত্ত বৈভব, কেনাকাটা, আত্মীয় পরিজন নিয়ে। মায়ের গর্ব তার মেয়ে ইংরেজিতে কথা বলে, আইফোন-আইপ্যাড ব্যবহার করে। তার মেয়ের বন্ধুরা অনেক ‘স্মার্ট’, তারা একসঙ্গে আড্ডা দেয়, খেতে যায়, হ্যাঙআউটে যায়! আগে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত। তারপর সন্ধ্যার পর, তারপর গভীর রাত...। একদিন দেখা গেল রাতে বাড়িতে ফিরল না মেয়ে। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, মেয়ে অবাধ্য, কথা শোনে না। কি যেন খায়...। চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা-মা। মেয়ের সেই ‘স্মার্ট’ বন্ধুদের সন্দেহ হয়। কিন্তু ততদিনে হাত গলে বের হয়ে গেছে সন্তান।

চারবছর আগে শিরোনাম হয়েছিলো সতের বছরের মুগ্ধ। স্কুল জীবন থেকেই নানা ধরনের বাজে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে মুগ্ধ। বাবা ঠিকাদার ও সেনেটারি ব্যবসায়ি। ছেলেকে দেওয়ার মতো সময় কই তার? আর মা? একটা সতের বছরের ছেলে নেশা করছে, বখে যাচ্ছে টেরও পাননি। কিন্তু চাওয়ার আগেই ছেলের সামনে হাজির করেছেন আলাদিনের চেরাগ। চেরাগ ঘষলে পাঁচ লাখ টাকার বাইক মেলে, বন্ধু মেলে। কিন্তু “বাবা-মা” মেলে না, সোহাগ-শাসন মেলে না। চেরাগে নেশা মেলে, জীবন তো মেলে না। শেষ অবধি দামি মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার আবদার পূরণ না করায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে মুগ্ধ।  

আজকের শিরোনাম দিহান। যার নামের আগে স্থায়ী হয়েছে “ধর্ষক” পরিচয়। নিজের বন্ধুকে গ্রুপ স্টাডির কথা বলে বাড়িতে ডেকে এনে ধর্ষণ করেছে এই সতেরোর কিশোরেরা। এই দিহান কিংবা দিহানদের বাবা মায়েরা নিশ্চিতই কোন ধর্ষক জন্ম দেননি।

কিন্তু দিহানরা ধর্ষক হয়েছে। দিহানদের ধর্ষক বানানো হয়েছে। একদিনে হয়নি। দিনে দিনে আমাদের চোখের উপরে, বন্ধ দরোজার ওপাশে “চটিয়াল” কিংবা “আঠার প্লাস আনসেন্সরড” নামে অনলাইন গ্রুপের বিকৃত উল্লাসের আখড়াতে ভিড়ে গিয়েছে দিহানেরা। আমাদের সন্তানেরা। আমরা যাদের হাতে একটা দামী ডিভাইস ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমিয়েছি। আমরা জানি না আমাদের সন্তানরা গ্রুপ স্টাডির নামে আমাদের চোখের সামনে দরজা বন্ধ করে মেতে ওঠেছে আট মিনিটের আনসেন্সরড ভিড়িওর বিকৃত সম্ভোগে।

নিরপরাধ সাধারণ মেয়ের ক্লিভেজ, বুক, পেট কিংবা ফেসবুকে পোস্ট করা ছবি চুরি করছে আর পাশবিক যৌনতার নীলে ভেসে যাচ্ছে। আমরা খবর রাখিনি বন্ধ দরজার ওপাশে ফয়েলের ধোঁয়ায় জীবন মুড়িয়ে নিয়েছে আমাদের সন্তানেরা। সেই বন্ধ দরোজা যখন খুলেছে তখন তারা কেউ ধর্ষক, কেউ নেশাখোর, কেউ খুনী। সেই খুনী সন্তানেরা আমাদের খুন করছে শরীর আর মনে। যে সন্তানের জন্য আমরা দশ দুয়ারী ভিখেরির মতো কুড়িয়ে কুড়িয়ে ভালোবাসা আর স্বচ্ছলতা জমিয়ে রেখেছিলাম, সেই স্বচ্ছলতার ছুরি আর আগুন আমাদেরই রক্তাক্ত করে, পোড়ায়।

নিজেদের জীবন পুড়িয়ে দাম শোধ করি আমরা মাতৃত্বের, পিতৃত্বের। হা জীবন !! হা নিয়তি !!! এই নিয়তি তো আমরাই লিখেছি দিনের পর দিন ধরে। আমাদের অসততায়, অবহেলায়, উদাসিনতায়, দায়িত্বহীন বেপরোয়া ব্যস্ততায় হাতের ফাঁক গলে আমাদের ঘুমঘোরে নষ্টের কাবুলিওয়ালা এসে চুরি করে নিয়ে যায় আমার সন্তান, আমাদের বুকের ওম না পেয়ে কোন সময় নেশার ওমে বুঁদ হয়েছে আমাদের সন্তান তা আমরা জানতেও পারি না!! সর্বস্ব হারিয়ে আমরা দাবি করতে থাকি পিতৃত্ব আর মাতৃত্বের।

আমাদের সন্তানরা শিরোনাম হয়। কিন্তু এই প্রশ্ন আমরা কখনো করি না, আমাদের হিসেবে কি তবে কোথাও ভুল ছিল? কোথাও কী বড় ফাঁক থেকে গিয়েছিল আমাদের মাতৃত্ব পিতৃত্বের? ভুল তো হয়েইছিল। আমরা সন্তান জন্ম দিয়েই ভেবেছিলাম “মা-বাবা” হয়ে গেছি। কিন্তু এই “মা-বাবা” হওয়াটাই ছিল মস্ত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি। সন্তান গর্ভে ধারন করে যথাসময়ে জন্ম দিলে বা ঔরস দিলেই, সবাই 'মা-বাবা' বলে হয়তো। কিন্তু 'মাতৃত্ব'! পিতৃত্ব!! তার যে অনেক দায়! 


কেই এই দিহান?

যেভাবে মানুষের ‘রুহ’ কবজ করা হয়

সম্পর্ক মধুর হয় যে কারনে


প্রাণের সাথে প্রাণের প্রেম, প্রাণ থেকে প্রাণের শুরু...এ এক অপার্থীব জীবন আবেদন। এই জীবন আবেদনে সন্তানের প্রাণের সাথে যোগাযোগ করতে না করলে কিসের মা-বাবা হওয়া! মাতৃত্ব আর পিতৃত্ব তো সেই বোধ, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়কেই বহন করতে হয় মায়া-মমতা, নিজের পাপ-পূন্যের জগত। যেখানে নিজের গর্ভে, নিজের রক্তমাংসে জীবন পাওয়া সন্তান "মা" বলে জড়িয়ে ধরে।  

যেখানে পিতা তার উত্তরাধিকারিকে দিতে প্রস্তুত তার সেরাটুকু, সবটুকু, সমস্ত কিছু। অথচ এই মাতৃত্ব পিতৃত্বের বোধটুকুই অনেক সময় আমরা ধারন করতে পারি না শেষ পর্যন্ত। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকে, নিজের ভালোবাসা আর শাসনের মধ্যে ব্যালেন্স করতে না পেরে, অন্যকে দেখাবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নিজের হাতে তুলে দিই

সন্তানের হাতে আমাদের মৃত্যুবান আর যখন আমাদের সন্তান খবরের শিরোনাম হয়ে যায়, তখন ভাবতে বসি, কোথা থেকে কি হয়ে গেল ? আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখি না, কতটা আমার ভুল আর কতটা দায়। আমার নাড়ি ছেঁড়া সন্তান কেন আমাকে পেছনে ফেলে ছুটে যায় জীবন হারানো ওই ভয়ঙ্কর মরিচিকার পেছনে? আমরা নিজেকে প্রশ্ন করি না, সন্তানের ভাষা বুঝতে না পারলে, সন্তানের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলে, সন্তানের জন্য কোন আদর্শ তৈরি করতে না পারলে আমার সন্তান “বখে” গেছে বলে বিলাপ করার কি মানে আজকে? 

আজকে হতভম্ব হয়ে কিছু শিরোনামের দিকে তাকিয়ে থাকার দায় কার? বাবা-মাকে খুন করার আগে ঐশি একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। একটা চিঠিও লিখেছিল। সে নিজে এটাকে সুইসাইড নোট হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঐশীর সেই চিঠি প্রতিটি বাবা মায়ের অবশ্য পাঠ্য। ঐশির সে চিঠি আমাদের বন্ধ চোখের অন্ধত্ব কতটুকু সারাবে জানি না, তবু সে চিঠি যতোবার আমি পড়ি ততোবার নিজেকে বারবার আয়নায় দেখি। বুঝার চেষ্টা করি সন্তানের হাতে জীবন দেয়ার পেছনে, কতটা আমাদের দায় আর কতটা নিয়তির।
 

মত ভিন্নমত বিভাগের সব লেখার দায় লেখকের । লেখার আইনগত বা অন্যকোনো দায়ও লেখকের ।

news24bd.আয়শা