ছুটির দিনে বই

ছুটির দিনে বই

Other

গতকাল সকালে বরেণ্য কবি আসাদ মান্নান সেলফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি, কী করছি?  জানতে চাইলেন, আজ 'ছুটির দিনে বই' নামে কিছু লিখছি কিনা। বললাম, ভাবছি কিছু একটা লিখবো হয়তো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধু'র 'আমার দেখা নয়াচীন ' বইটির ওপর রিভিউ করতে অনুরোধ করলেন।  

আরও বললেন, তোমার গদ্য লেখাটা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে এবং খানিকটা আনন্দও দেয় বটে।

আমিও তাঁকে যথাযথ বিনয়াশ্বস্ত করি। উল্লেখ্য, তিনি ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র ওপর আমার রিভিউ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পড়েছিলেন।  

কোন বিলম্ব না করে শেলফ্ থেকে বইটি বের করে হাতে নিই। দেখি আমার হাতেই লিখা 'পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র, তারিখ ২২ মার্চ ২০২০ খৃষ্টাব্দ'।

অর্থাৎ চলমান করোনাকালের দুঃসহ কালো দিনলিপির শুরুতেই বইটি ক্রয় করে ঘরে নিয়ে এসেছিলাম।

'আমার দেখা নয়াচীন' বইটির প্রথম প্রকাশ ১৮ মাঘ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ খৃষ্টাব্দ। প্রকাশক বাংলা একাডেমি, ঢাকা । ১২০ পৃষ্ঠার বই, সঙ্গে খাতার খসড়ানোটস্, সফরের দুর্লভসব ফটোগ্রাফস্ , বঙ্গবন্ধু'র জীবনপঞ্জি, টীকা ও নির্ঘন্টসহ মোট ১৯৯ পৃষ্ঠা।  

বঙ্গবন্ধু দু'বার নয়াচীন সফর করেছিলেন। প্রথমবার ১৯৫২ সালে ০২ থেকে ১২অক্টোবর পর্যন্ত পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে ( peace conference of the Asian and Pacific Regions) তিনি আওয়ামী লীগের একজন তরুণনেতা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন।  


১২ বছরে পদার্পণ করছে দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক কালের কণ্ঠ

ঘরের মধ্যে পশু তৈরি হচ্ছে কী না দেখা জরুরি


ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরে এই সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। এতে ভারতের শিক্ষাবিদ মনোজ বসু ভীষণ আনন্দিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে প্রশংসা করেছিলেন। সম্মেলনে ৩৭টি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সমগ্র পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। পূর্ববাংলার ভাগে মাত্র পাঁচজন নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্যতম একজন।  

এর দলপতি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের একজন বিখ্যাত নেতা পীর মানকী শরীফ। উল্লেখ্য, এতে তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমতও অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বঙ্গবন্ধু '৫২ সালের এ সফরের ঘটনাবলী লিখে রাখেন ১৯৫৪ সালে কারাগারে থাকাবস্হায়।  

দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধু চীন সফর করেন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য বা পূর্ববাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে। পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে সেটি ছিল সরকারি সফর। ১৯৫৭ সালের ২৪ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত সময়ে এ সফরকাল ছিল। তাঁর উভয় সফরই হয় চীনের আলোচিত সামরিকজান্তা চিয়াং কাইশেক পরবর্তী নয়াচীনের প্রবক্তা, বিপ্লবী ও তাত্বিক, মাওবাদের জনক তথা কমিউনিস্ট নেতা মাও সে তুং এর সময়। যাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ১৯৪৯ সালের ০১ অক্টোবর নয়াচীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা ছিল দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের চুড়ান্ত পরিণতির প্রত্যাশিত ফল।  

বঙ্গবন্ধু বিপ্লবোওর গনচীনের শাসনব্যবস্হা ও মানুষের জীবন জীবিকার বাস্তব চিত্র স্বচক্ষে অবলোকন করেন। যা তিনি পরবর্তীতে অসাধারণ মানবিকতা ও সংবেদনশীলতার দরদী ভাষায় তুলে ধরেছেন। এতে তিনি কখনো কখনো সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ বিরোধী মনোভাবও ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, "আমি কমিউনিস্ট নই তবে গনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সবসময় বিশ্বাসী। এমনকি সমাজতন্ত্রেও আমার আস্হা আছে"। একজন তরুণ মেধাবী রাজনীতিকের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-সাধনা, দেশপ্রেমবোধ, মানবজাতির ইতিহাস ও সমাজ সংস্কৃতিতে মুগ্ধ দৃষ্টিপাত সবই প্রগাঢ় অনুভূতিতে প্রতিভাত হয়ে উঠে আসে তাঁর এই ভ্রমণকাহিনিতে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন," ট্রেন থেকে আমি বাহিরের দিকে চেয়ে দেশটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। মনে হলো এ তো আমার পূর্ব বাংলার মতো সকল কিছু। সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে মাটির ঘরের গ্রাম, ছোট ছোট নদী, ট্রেনটা পার হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার কোদাল দিয়া জমি ঠিক করছে। বেশ লাগছে দেশটাকে "।  

ভ্রমণে বৃক্ষ, পুস্প, তরুলতা, বিহঙ্গ কোন কিছুই যেন তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। নয়াচীন বিপ্লবের পূর্বে সমগ্র জাতি যেন নেশায় বুদ হয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু এদের আফিমখোরের জাত বলেছেন। তিনি মানুষের আফিম খাওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলেন, সরকার এ আফিম খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে তথাপি লুকিয়ে কেউ কেউ তা খাচ্ছে। তারা জানে, ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হবে। তবু  দু 'একজন খেয়েই চলেছে। তবে তিনি আশা করেছেন, শতকরা আশি ভাগ মানুষ যেহেতু ছেড়ে দিয়েছে বছর তিনের মধ্যে বাকিরাও এটি ত্যাগ করবে।  

তিনি নয়াচীনে গিয়ে মুসলমানসহ বিভিন্ন জাতির জীবন-যাত্রা সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং গ্রামের অভ্যন্তরের একেবারে প্রান্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন। আজকের মাও সে তুং এর কমিউনিস্ট সরকার আর পূর্বের চিয়াং কাইশেক সরকারের মধ্যে গুনগত বা নীতিমালায় পার্থক্য কোথায় তাও তিনি সযত্নে পরখ করে দেখার প্রয়াস করেন। চীনেও সাধারণ মানুষ কুসংস্কার আচ্ছন্ন ছিল, ধর্মব্যবসা ছিল, পীর ধরার প্রথা ছিল এসব তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু'র লেখায় তথ্য -- "তখন চীনের লোক সংখ্যা ৬০ কোটি, তিন সম্প্রদায় প্রধান, ৮০% বৌদ্ধ, প্রায় ৫ কোটি মুসলমান আর কিছুসংখ্যক খৃষ্টান। কিছু প্রদেশে প্রায় ৯০% মুসলিম ছিল"।  

১৯৫২ সালে নয়াচীন সফরে পূর্ব বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু'র সাথে সফরসঙ্গী ছিলেন আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও লেখক ইউসুফ হাসান। বঙ্গবন্ধু তাঁদের কিছু ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও গুণের কথাও মাঝে মধ্যে রসিকতার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। সফরকালে তিনি হংকং, সাংহাই, পিকিং (বর্তমান বেইজিং),  তিয়ানজিং, ক্যান্টন,নানকিং ইত্যাদি শহর ঘুরেছেন এবং নানাবিধ বিষয়ে বিচিত্র বর্ণনা দিয়েছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কোথায় কেমন এমনকি পাকিস্তানের সাথে তুলনামূলক হারও বর্ণনা করেছেন।  

এ বইয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় যেসব নাম বার বার উল্লেখ করেছেন এর মধ্যে-- চা, ইংরেজ, কমিউনিস্ট, বার্মাদেশ, চিয়াং কাইশেক, চৌ এন লাই, নয়াচীন, মাও সে তুং, মুসলমান, সাংহাই, হংকং,ম্যাডাম সান ইয়াৎ সেন।   

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বা 'কারাগারের রোজনামচা'র মতো 'আমার দেখা নয়াচীন'ও অনেক সুখপাঠ্য এবং তথ্যে- উপাত্তে সমৃদ্ধ এক অনন্য ঐতিহাসিক দলিল। বলা যায়, ভবিষ্যতের নির্ভরশীল রাজনীতিকব্যক্তিত্ব, মননশীলতা এবং মাটি ও মানুষের জীবনভাবনায় নিবেদিত হতে যুদ্ধোওর নয়াচীন ভ্রমণ ছিল বঙ্গবন্ধু'র জন্য এক অনুপম রাজনৈতিক সোপান।  
২৫ পৌষ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।  

news24bd.tv / কামরুল

এই রকম আরও টপিক