কয়েকজন হারানো মানুষ, রোমাঞ্চকর শৈশবের দিনগুলি এবং...

কয়েকজন হারানো মানুষ, রোমাঞ্চকর শৈশবের দিনগুলি এবং...

Other

ফেলে আসা দিনগুলিকে খুব মিস করি আমি। আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলোর কথা মনে করি। সেই জীবন যেমন অনেক সংগ্রাম মুখর ছিল তেমনি পুষ্পের ঘ্রাণে ভরা ছিল, আনন্দের ছিল। স্বপ্ন কাজল মাখা ছিল সেই দিনগুলি।

অভাব, অনটন, অপ্রাপ্তি আর টানাপোড়েন ছিল আবার অনেক মাধুর্য্য মাখা ছিল। সেই সব মায়ার কাজল পরানো দিনগুলোর কথা কখনো ভোলা যায় না।

কৈশোর উত্তীর্ণ সময়টা আলো আঁধারিতে ভরা থাকে। শরীরে স্বাদ গন্ধ পাওয়া যায়।

সে রকম বয়সে আমার বেশ কিছু মানুষের সাথে সখ্যতা হয়েছিল। নারী পুরুষ দুই ধরণের মানুষ। বন্ধুরাই আমার জীবনে সব। তারাই প্রেরণা, তারাই আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আজীবন বন্ধুরা আমাকে ভালবাসা দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, আনুকল্য দিয়েছে। আমার কষ্টের দিনে পরম মমতায় পাশে থেকেছে।  
পরবর্তীকালে কেমন করে জানিনা অনেকের সাথেই বিচ্ছিন্নতা এসেছে। হতে পারে আমার ব্যস্ততা বা বিদেশ চলে আসার কারণে এমনটা হয়েছে। সব দোষ আমার। আবার তাদেরও দায় আছে। তবে আমার দিক থেকে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়নি। তাদেরকে খুঁজে বেড়াই আমি। এইসব মানুষেরা আমার জীবনে ভালবাসার ডালি নিয়ে এসেছিল। আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছিল, ভালবাসা শিখিয়েছিল, বন্ধুত্ব আর প্রেমের স্বরুপ চিনেছিলাম। কখনো সেটা চিঠি পত্রের মাধ্যমে, কখনো ব্যাক্তিগতভাবে। আজকে যেটা ভার্চুয়াল সেটা একসময় ঘটত পত্রের মাধ্যমে। চিঠি পত্রের আবেদন আমার জীবন ব্যাপক ছিল।

সে সব বন্ধুর মধ্যে একজন ছিলেন মসিউর রহমান খোকন। সোনালি ব্যাংকে চাকরি করতেন এবং লেখালেখি করতেন নিয়মিত। আমার বিচিত্রায় সাংবাদিকতার শুরুর সময় তার অনেক সহযোগিতা আমি পেয়েছি। শামীম আজাদ জীবন এখন যেমন বিভাগের জন্য রিডার্স ডাইজেষ্ট থেকে আর্টিকেল অনুবাদ করতে দিতেন আমাকে। আমি কোথাও আটকে গেলে খোকন ভাইর হেল্প নিতাম। তিনি সুন্দর মনের একজন মানুষ ছিলেন। ১৯৮০ সাল থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। পত্রমিতালি দিয়ে শুরু। চমৎকার কথামালা দিয়ে চিঠি লিখতেন আমাকে। সেখান থেকে মাঝে মাঝে কোট করে অন্য বন্ধুদের লিখতাম আমি। জানি না কেনো হঠাৎ করেই তিনি সবার কাছ থেকে আড়ালে চলে গেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও নেই তিনি। কেউ যদি তার খোঁজ পান প্লিজ আমাকে জানাবেন। আমি তার কাছে একবার সরি বলতে চাই।

আমি তখন বরিশাল থাকি। পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখি। পত্রমিতালী করি। তখন আরও কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে রজনী নামে একজন ছিলেন। বিচিত্রায় ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন লিখে সারা ফেলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় পড়তে আসার পর তার সাথে একবার দেখা হয়েছিল। রজনী ছিল তার ছদ্মনাম। এই নামে তাকে কেউ চিনত না। আমাকে একবার বাসায় ইনভাইট করেছিলেন। আজিমপুর থাকতেন। অপরুপা দেখতে ছিলেন। একদিন হঠাৎ আমেরিকার হাওয়াই থেকে তার একটা চিঠি আসল আমার কাছে, হাজবেন্ডর সাথে কয়েকটা ছবি সহ। তাও প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। কোনো ঠিকানা ছিল না চিঠিতে।

মহসিনও ছিল আমার পত্রবন্ধু। খুব সহজ সরল একজন মানুষ ছিল। মালিবাগে একটা ওষুধের দোকানে কাজ করত। দোকানটা ছিল মহসিনের আত্মীয়র এবং খুব চালু দোকান ছিল। আমাকে খুব মায়া করত। অমায়িক একটা হাসি ছিল মুখে সবসময়। কখনো রাগতে দেখিনি। একসাথে আবাহনীর খেলা দেখতে যেতাম আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে। তখন মাঝে মাঝে ঢাকা আসি সুপার লীগের খেলা দেখতে। খোকন ভাই তখন এসএম হলে থাকতেন। তার কাছেও থাকতাম। যখন নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, মহসিন হলে থাকি। সেসময়টা ছিল খুব টানাপোড়েনের। প্রায়ই খাওয়ার পয়সা থাকে না আমার। মহসিন আমাকে রেষ্টুরেন্টে মজার মজার খাবার খাওয়াত। সে নিজেও খেতে ভালবাসত। চটপটি ছিল তার খুব প্রিয়। অনেক পরে একদিন জানলাম মহসিন কাজ ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে!  

জালালের সাথে পরিচয় আমার স্কুল বন্ধু রুপকের মাধ্যমে। নিউ মার্কেটে নলেজ ভিউ নামে একটা বনেদি বইয়ের দোকান ছিল। জালালের বড় ভাই ছিলেন দোকানের মালিক। খুব চালু দোকান। আমি সেখানে প্রায়ই যেতাম। হলে থাকি। কাছেই নিউমার্কেট। বই দেখতে যেতাম। এক পর্যায়ে জালালের সাথে এমনই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমাকে এমনি এমনি বই দিত পড়তে। আমার পছন্দের বই নিয়ে আসতাম। বিয়ের পর যখন অর্ক হলো তখনও যেতাম। অর্ককে অনেক আদর করত। অর্ক দোকানে গিয়ে সব বই উল্টা পাল্টা করত, বিক্রী বন্ধ হয়ে যেতো কিন্তু জালাল কিছু বলত না।

অর্কর বই পড়ার অভ্যাস তৈরী হয়েছিল জালালের কারণে। অর্ককে গাদা গাদা শিশুতোষ বই দিয়ে দিত জালাল। একদিন নলেজ ভিউ ছেড়ে দিয়ে নিজেই বাংলাবাজারে জ্ঞান বিকাশ নামে একটা প্রকাশনী করেছিল। আমার দুটো বইও প্রকাশ করেছিল। সেটাও একদিন বন্ধ হয়ে গেলো। সেই থেকে জালালকে আর খুঁজে পাই না। এভাবেই আমি অনেক মহার্ঘ বন্ধু হারিয়েছি। তালিকা বেশ লম্বা হবে। এজন্য দায়ী আমি। আমি সহজে কিছু পাই না। আবার পেয়েও হারাই।

ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আমাকে সবসময় আবেগ তাড়িত করে। স্মৃতি ছাড়া মানুষের আর কিছ নেই। রাতের গভীরে ঘুম ভেঙ্গে যায়, দু’চোখ জলে ভিজে উঠে। চোখের সামনে সিনেমার সেলুলয়েডের ফিতার মতো একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠে। কখনো মা সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘুমের মধ্যে কিছুতেই মায়ের কন্ঠস্বর থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। যেনো মা জসিম জসিম বলে ডাকছে। বরিশালের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি রাস্তা ঘাট, প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, অলি, গলি, তার আনাচ কানাচ ,প্রতিটি মানুষ আমাকে শুধু পিছু টানে। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত সব মানুষ সামনে এসে ভীড় করে। তখন অস্থির হয়ে উঠি। ঘুম আসে না। যারা চলে গেছেন তারাও সামনে এসে দাঁড়ায়। সাজু আসে, মৌরি আসে, আমার ভাইয়েরা, দুলা ভাই আরো অনেকে। আবার অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনকে আন্দোলিত করে। হারানো বন্ধুরা স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠে।

বরিশালেও আমার অনেক বন্ধু ছিল, পাড়ার বন্ধু ছিল,। স্কুল কলেজের অনেক বন্ধু, যাদের হারিয়ে ফেলেছি। নাসির ছিল ক্লাসের ফার্ষ্টবয়। আমাকে প্রথম উপন্যাস পড়তে দিয়েছিল নাসির। বইটির নাম ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের তৈইশ নম্বর তৈলচিত্র। আমরা খুব বই বিনিময় করতাম। স্কুলের সেই দুরন্ত দিনগুলোর বন্ধুদের কথা সহজে ভোলা যায় না। হুমায়ূন ছিল সেই বন্ধুদের একজন। আমার সাথে এমনই সখ্যতা ছিল যে একদিন ক্লাসে না আসলে আমাকে জবাবদিহি করতে হতো। আমার হাতে বেতের বারি পড়ত। টিচাররা মনে করত আমি জানি সে কোথায় আছে। হয়ত অই সময় হুমায়ূন খ্যাপে মারামারি করতে গেছে। আলেকান্দার ছেলে। মারামারিতে তখন বিখ্যাত বরিশালে।

বরিশালে আমাদের বাড়িটার কথা না বললেই নয়। খুব বৈচিত্র্যময় ছিল। বিশাল বড় ফ্যামিলি আমাদের। এতোটাই বড় যে চারটা ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অনেক গাছগাছালি, ফলফলাদি গাছ, ঘন সবুজ বন জঙ্গল, বাঁশঝাড়। রাতে শেয়াল ডাকে, জোনাকি পোকারা টিপ টিপ আলো ফেলে, নিঝুম দুপরে  যখন বাড়ির মহিলারা ভাতঘুম দেয় তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকারা একটানা ডেকে যায়, ঘুঘুর মন কেমন করা ডাক শোনা যায়। পুকুর আছে দশ বারেটা, তাতে ভরভরন্ত পানি আর মাছেরা সাঁতার কাটে। অনেক মানুষ বাড়িতে। গোনাগুনতি নাই। আমিও তারমধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই একলা, কালো জাম কুড়াই, ঢেকির শাঁক খুঁজি। কাটা ঘুড়ির পিছনে দৌঁড়াই। নানা অনুষ্ঠান হতো আমাদের বাড়িকে কেন্দ্র করে। আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব দিতাম। আমার বড়রা বাৎসরিক নাটক করতেন মঞ্চ করে। সেটা ছিল একটা উৎসবের মতো। শহরজুড়ে লোকজন ছুটে আসত নাটক দেখতে। আমরা রাতের পর রাত রিহার্সেল দেখতাম।

মল্লিক বাড়ির পুল ছিল বিখ্যাত। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে রিক্সাওয়ালাকে বললেই নিয়ে আসত। নাটক ছাড়াও আমরা ফুটবল, হাডুডু, হকি টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম। শীতের বিকেলে আমাদের মাঠে নেট টাঙ্গিয়ে ভলিবল খেলা হতো এবং রাতে লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন। বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব ছিল আমাদের। রেজিস্টার্ড ক্লাব। ক্লাবের উদ্যোগেই এসব করতাম আমরা। এলাকার সববয়সী শিশু কিশোরদের এনগেজ রাখতাম খেলাধুলায়। কেরাম প্রতিযোগিতা হতো, বই পড়ার প্রতিযোগিতা করতাম। বাৎসরিক নৌকা বাইচ, সাঁতার, ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত হতো আমাদের পরিবারের উদ্যোগে। যাত্রাপালা হতো। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত যাত্রাপালা দেখত। অনেক বড় বড় জাম গাছ ছিল আমাদের বাড়িতে। অত্র অঞ্চলের লোকজন জাম পেরে নিয়ে যেতো। ছিল লিচু, কুল, আমলকি, জলপাই, কামরাঙ্গা, ডউয়া, গাব, জাম্বুরা, আমলকি, সফেদা, নইল সহ নানা ফলের গাছ। আম কাঠাল তো ছিলই।

আরও পড়ুন:


বাইডেন প্রশাসনে আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতের নাম

করোনা নেগেটিভ সনদ কী তাহলে ভুল ছিল?

আবারও ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত মোশাররফ রুবেল

‘ইরান-আমেরিকা সম্পর্কে ‘নতুন সুযোগ’ সৃষ্টি হয়েছে’


এখন সে সব আর নেই তেমন। মানুষ গুলোই শুধু আছে কিন্তু সেই সুন্দর দিনগুলো আর নেই। এখন সবাই বৈষয়িক। টাকা পয়সা, ব্যবসা বাণিজ্য, কেরয়িার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। মানিসক বিকাশের কোনো সুযোগ আর নেই। নেতৃত্বের অভাবে সব বন্ধ হয়ে গেছে। খালে বিলে ঝাপ দেওয়া নেই, পুলের গোড়ায় ছোট্ট টং রেষ্টুরেন্টে সকালে পরোটা আর ভাজি খাওয়া নেই, দুপুরে ডুবা তেলে ভাজা গুলগুল্লা খাওয়া নেই। সেই জাম গাছ নেই। পুকুরে সাঁতার কাটা নাই, শেঁওলা জমে গেছে পুকুরে। খালগুলো মরে গেছে। সেই জোয়ারের ঘোলা পানির স্রোত নেই , খেলার মাঠে কেউ খেলতে নামে না, পাঠাগার বন্ধ হয়ে গেছে কবেই। এখন কেউ চিঠিও লেখে না। পত্রমিতালি নেই। ডাক পিয়নের সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে চিঠি নিয়ে আসা নেই। নাটক নেই, ভলিবল খেলা নেই, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নেই, যাত্রাপালা নেই, নৈাকা বাইচ নেই। কারো হাতে বই নেই কিন্তু সবার হাতে আছে মোবাইল।

এসবের মধ্যেই আমি বেড়ে উঠেছিলাম। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছিল। বরিশালের অপরুপ নৈসর্গ্, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা। কৈশোরে আমি অনেক দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। আমার দূরন্তপনার জন্য আমার মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। বাড়ির অন্যদের আমার সাথে মিশতে দিত না যদি নষ্ট হয়ে যায়! আমি রাস্তার ছেলেদের সাথে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম, স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতাম, গাছে চরতাম, সাইকেলের রিং চালাতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম, সাইকেল চালিয়ে  শহর দাপরে বেড়াতাম। মেডিক্যাল কলেজ কলোনিতে ডাক্তারদের সুন্দরী কন্যাদের দেখতে যেতাম।

আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী এক কিশোর। আমাদের পরিবারটি ছিল একটু সামন্তবাদী। আমি ওসবের তোয়াক্কা করতাম না। তাই একটু বড় হয়ে যখন আমার তেরো চৌদ্দ বছর বয়স আমি আকস্মিক নির্জন হয়ে গিয়েছিলাম। দলছুট হয়ে গেছিলাম। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা গড়ে তুললাম। গাছেদের সাথে, পোকামাকরের সাথে, কীট পতঙ্গের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। আমার ভিতরে এক অন্য আমির আবির্ভাব ঘটেছিল। আমার মা, আমার খেলার সাথীরা অবাক হয়েছিল। তখন আমি বইয়ের জগতে নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। সেই খোঁজা আজও শেষ হয়নি।

লেখক, জসিম মল্লিক, সাংবাদিক, কানাডা

news24bd.tv আহমেদ

সম্পর্কিত খবর