বিষ হাতে মানুষের ভিড়ে খুনিচক্র

প্রতীকী ছবি

বিষ হাতে মানুষের ভিড়ে খুনিচক্র

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন সাভার থেকে পার্টির কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নিয়ে বাসে ফিরছিলেন। বাসটি ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে পৌঁছলে সব যাত্রী নেমে গেলেও তিনি বাসের ভিতরে পড়ে থাকেন। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টায় মারা যান তিনি।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বিষক্রিয়ায় তিনি মারা গেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) জুনিয়র অফিসার শামসুদ্দিন আহমেদ গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি বাসে টঙ্গী যাচ্ছিলেন। বাসটি টঙ্গি পৌঁছলে সব যাত্রী বাস থেকে নেমে পড়লেও তিনি সিটেই পড়ে থাকেন। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছিল।
বাসের লোকজন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। রাতেই তিনি মারা যান। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে তিনি প্রাণ হারান। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার খবির উদ্দিন দর্জির ছেলে শামসুদ্দিন ঢাকার সেগুনবাগিচায় থাকতেন। ঘটনাটি কয়েক মাস আগের।

ছদ্মবেশী ভয়ঙ্কর চক্র বিষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পথে-ঘাটে, যানবাহনে মানুষের ভিড়ে মিশে আছে তারা। সুযোগ পেলেই সেই বিষ প্রয়োগ করছে সাধারণ মানুষের ওপর। অজ্ঞান করার ওষুধ প্রয়োগে রীতিমতো হাসতে হাসতে মানুষ হত্যা করছে। এর পরই লুটে নিচ্ছে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী। ভ্রাম্যমাণ ভয়ঙ্কর এই খুনিচক্র যারা অজ্ঞান পার্টি হিসেবে পরিচিত, তাদের খপ্পরে পড়েই মৃত্যুবরণ করেছেন শামসুদ্দিন আর জাহাঙ্গীর।  

তবে এ দুটি মৃত্যুই নয়, একইভাবে পথেঘাটে, যানবাহনে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ। আর আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিদিনই। যারা প্রাণে বাঁচেন, তাদের অধিকাংশই শরীরে নানা জটিল সমস্যায় ভুগছেন। হাসপাতালের রেকর্ড তা-ই বলছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, গত ছয় বছরে মেডিসিন বিভাগে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে অসুস্থ হওয়া ৩ হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। মিটফোর্ড হাসপাতালেও একই সময়ে ১ হাজার রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সময় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে ৩০ জনের ওপরে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে ওই দুই হাসপাতাল সূত্রে।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজ্ঞান বা মলম পার্টির সদস্যরা মানুষের ওপর চেতনানাশক ওষুধ ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করে। এসবের বিষক্রিয়া মানবদেহের জন্য মারাত্মক। ডাক্তার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অজ্ঞান পার্টির চক্রগুলো আমদানিনিষিদ্ধ এটিভেন ট্যাবলেট বেশি ব্যবহার করে। এপিট্রা নামে একটি তরল ওষুধও ব্যবহার করে তারা। এ ছাড়া মিডাজোলাম, নাইট্রাজিপাম, মাইলাম, ডর্মিকাম, মিলানসহ কয়েকটি ঘুমের ট্যাবলেট ব্যবহারের আলামতও মিলেছে। ক্লোরোফর্ম-জাতীয় ওষুধ নাকে ধরেও পরিবহনের যাত্রীদের অচেতন করা হচ্ছে। অপকর্মে ব্যবহৃত ওষুধগুলোকে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ‘মিথাইল’ বলে। আর মলম পার্টির সদস্যরা বিষাক্ত মলম ও মরিচের গুঁড়া চোখে মেখে বা ছিটিয়ে দেয়।

চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রেই রাজধানীর মিটফোর্ড, শেরেবাংলানগর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শাহবাগ, গুলিস্তান, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় এসব ওষুধ সহজে মেলে এবং দেদার বিক্রি হয়। তবে সূত্রগুলো জানিয়েছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের রয়েছে নিজস্ব বিক্রেতা। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশের চিত্র এটি। সূত্রগুলো জানিয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে প্রায়ই নিষিদ্ধ ওষুধসহ অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা গ্রেফতার হয়। গত ছয় বছরে ঢাকায় সহস্রাধিক গ্রেফতার হয়েছে। শুধু রাজধানীতে ৪০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে অজ্ঞান পার্টির ৪০০ সদস্য এসব অপকর্ম করছে বলেও তথ্য আছে গোয়েন্দাদের হাতে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া বেশ কয়েকজনের কাছে এটিভেন ট্যাবলেট পাওয়া গেছে। ভাটারা থেকে ১ হাজার পিস এটিভেনসহ ভুলু মিয়া নামে এক অজ্ঞান পার্টির সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ভুলু জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে ১২টি চক্র আছে যারা একই দলভুক্ত। যাদের প্রত্যেকের হাতে হাজার হাজার এটিভেন ট্যাবলেট আছে। আগে পাকিস্তান থেকে এটিভেন এলেও এখন আসে ভারত থেকে।

চিকিৎসক ও ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, গরম ও ঈদের সময় অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেশি দেখা গেলেও এখন সারা বছরই এদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির একটি ‘অপারেশনে’ তিন থেকে চারজন সদস্য থাকে। কখনো কখনো এ সংখ্যা ১০-১২ জন বা ১৫-২০ জনও হতে পারে। চক্রের একটি গ্রুপ নগরীর ব্যস্ততম স্থানে ডাব, কোমল পানীয়, আচার, ঝালমুড়ি, ফলমূল, চানাচুর ভাজা, শসা, খেজুর, আম, সিগারেট, পান, জুসসহ নানা খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ক্রেতা সেজে সেখানে গিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। টার্গেট ব্যক্তির কাছে চেতনানাশক মেশানো পণ্যটি বিক্রি করার পর ওই ক্রেতাকে গভীরভাবে অনুসরণ করা হয়। ওই ব্যক্তিটি অচেতন হতেই অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সব হাতিয়ে নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টার্গেট ব্যক্তির স্বজন সেজে হাসপাতালে নেওয়ার নাম করে পথেই সর্বস্ব লুটে নেয়।

আবার ছদ্মবেশী হকাররা কবিরাজি পণ্য, আচার, চকোলেট প্রভৃতি বিক্রির নাম করেও সর্বস্ব লুটে নেয়। তারা প্রচারের জন্য প্রথমে ফ্রি খাওয়ার অফার দেয়। অন্য যাত্রীদের স্বাভাবিক খাবার দিলেও টার্গেট ব্যক্তিকে দেওয়া হয় চেতনানাশক মেশানো খাবার।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা জানিয়েছে, টার্মিনাল বা স্টেশনে তাদের একাধিক সদস্য অন্য যাত্রীদের সঙ্গে টিকিট কাটতে লাইনে দাঁড়ায়। সাধারণ যাত্রীরা যখন মানিব্যাগ বের করে তখন তারা মানিব্যাগের দিকে নজর দেয়। তারা দেখে, ব্যাগে মোটা অঙ্কের টাকা আছে কিনা। এ ছাড়া যখন কারও ফোন আসে তখন টার্গেট ব্যক্তির মোবাইল ফোনের দিকে নজর দেয়। দেখে নেয়, ফোনটি দামি কিনা। সঙ্গে থাকা ব্যাগে ল্যাপটপ বা দামি কোনো কিছু আছে কিনা। পরে টার্গেট ব্যক্তির পাশে, সামনে বা পেছনের সিটে টিকিট কাটে তারা। এরপর ওই যাত্রীর সঙ্গে গাড়িতে উঠে তার সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠে। এরপর নানা কৌশলে চেতনানাশক খাইয়ে দেয়। আর সর্বস্ব লুটে নিয়ে দেয় চম্পট।  

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সবই তাদের হাতের কাজ। চোখের সামনেই সব করে। কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। ডাব কাটবে, ছিদ্র করবে। তারপর এক হাত ডাবের নিচে রেখে অন্য হাতে থাকা ওষুধ মেশাবে। আর ওই পানি খেয়েই জ্ঞান হারাবেন ক্রেতা। যে কারণে সজাগ থাকতে হবে সবসময়। ’ 

পুলিশ বলছে, যাত্রাপথে অপরিচিত লোকের সঙ্গে সখ্য গড়ে না তোলা ও তাদের দেওয়া খাবার পরিহার করলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কারও হাতে রুমাল দেখলে সতর্ক থাকুন। কারণ, রুমালের মধ্যে ক্লোরোফর্ম মিশিয়ে নাকের কাছে ধরলে যে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সচেতনতাই ভয়ঙ্কর অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায়। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

সম্পর্কিত খবর