না মরি, আমরা প্রেমের নামে!

না মরি, আমরা প্রেমের নামে!

Other

ঘটনা এক

দুইদিনের দারুণ ভ্রমণ শেষে শ্রীমঙ্গল ট্রেন স্টেশনে বসে আছি। ট্রেন আসতে দেরি হবে-ইনিয়ানার দৌড়াদৌড়িতে অস্থির। ওর পেছনে ছুটতে ছুটতেই খেয়াল করলাম, দুই তিন জনের জটলায় বছর বিশ বাইশের এক নারী ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। ভাবলাম, বিপদে পড়েছে কিনা জানা উচিত।

প্রথমে কিছুই বললেন না। কাঁদছেন তো কাঁদছেনই। বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ করে দৌড়ে ট্রেনলাইনের দিকে যেতেই, জটলার দুই তিনজন তাকে ধরে নিয়ে আসলেন।

এবার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো।

ইনিয়ানাকে সহযাত্রীর জিম্মায় রেখে আবার গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই, হড়বড় করে তিনি সিলেটি ভাষায় যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো, 'এ জীবন তিনি রাখবেন না, এখনই ট্রেনের তলে মাথা দেবেন, তার সর্বস্ব লুটপাট হয়ে গেছে, এখন আর বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। ' কাঁদতে কাঁদতেই জানালেন, তার একবছর ধরে ফোনে কথা একজনের সাথে, ফোনে কথা বলতে বলতেই প্রেম এবং দেখাসাক্ষাৎ। তারপর সেই প্রায় অচেনা প্রেমিকের পরামর্শ ও প্রলোভনে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সাতদিন আগে। পরিকল্পনামত তারা স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে থেকেছে এবং ঘুরেছে শ্রীমঙ্গল গত কয়েকদিন। ট্রেন স্টেশনে এসেছে, চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য, ওখানে গিয়েই বিয়ে রেজিস্ট্রি হবে। স্টেশনে মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে, এখন কথিত স্বামী /প্রেমিক গত চার ঘণ্টা ধরে উধাও এবং তার ফোন ও ধরছেনা।

মেয়েটিকে যেহেতু তার বাবা মা ভাইবোন অচেনা ছেলের সাথে প্রেমের ব্যাপারে সাবধান করেছিল, এখন ফেরত গেলে সে ছোট হয়ে যাবে, আর বাবা মা গ্রামবাসীর কাছে মুখ দেখাতে পারবে না; তাই বাবা-মার বাড়ি সে ফেরত যাবে না। সুতরাং আত্মহত্যা তাকে করতেই হবে।  

মেয়েটির কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে আমার ফোন থেকে ছেলের নাম্বারে ফোন করলাম, এবং ছেলে যথারীতি সব অস্বীকার করে জানালো, মেয়েটিকে সে চেনেই না।  

আত্মহত্যাপ্রবণ মেয়েটিকে কিছুক্ষণ কাউন্সেলিং করার চেষ্টা করলাম, তার বাবা-মার নাম্বার চাইলাম, এমনকি ঢাকা নিয়েও আসতে চাইলাম, কিছুতেই সে রাজি নয়। এ জীবন সে রাখবেই না। বুঝিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না। আর আমার ট্রেনের সময় হয়ে আসায় স্টেশনের রেল পুলিশকে খুঁজে তাদের সব বলে মেয়েটিকে অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা রওনা করলাম। ঢাকা এসেও কয়েকদিন ভেবেছি, মেয়েটির কথা, অনেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে তার জলেপড়া, ক্রন্দনরতা অসহায় চেহারা। শেষ পর্যন্ত  তার কি হলো, তা আর জানা হবে না কোনদিন।

ঘটনা দুই

আমার বাসায় সাহায্য করে যে মেয়েটি, সে এতো ভদ্র, গোছানো ও সৎ একজন মানুষ, যে তাকে আমরা প্রায় পরিবারের সদস্যের মতই মনে করি। এই মেয়েটি চট্টগ্রাম, বাঁশখালীর কোন এক সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ির মেয়ে। প্রেমের ফাঁদপাতা ভুবনে, যখন সবই রঙিন লাগে, সেই বয়সে পালিয়ে এসেছিল ঢাকা। ফোনে পরিচয়, শুদ্ধভাষায় কথা বলা, বিএ পাশ দাবী করা প্রেমিক তাকে অবস্থাপন্ন ঘরের মোটামুটি নির্বিঘ্ন জীবন থেকে নামিয়ে এনেছে একরুমের প্রায় বস্তি বাসা আর চার বাড়ি কাজ করে, নিজের ও পাঁচ বছরের ছেলের ভাতকাপড়, পড়াশোনার খরচ যোগানের জীবনে। এবং পেশায় ড্রাইভার, নবম শ্রেণী পাশ, প্রায় শুদ্ধ কথা বলা স্বামী আবার ফোনে নতুন প্রেম করে যাচ্ছে, তার চোখের সামনে!

ঘটনা তিন
 
ফোনে পরিচয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়ে আলাপের শুরু। তড়িঘড়ি বিয়ের পর চিকিৎসক নারী জানতে পারলেন প্রতারিত হয়েছেন প্রেমের নামে। স্বামীজী ভর্তিই হয়েছিলেন, পাশ করে আর বেরোতে পারেননি। আর প্রেমে অন্ধ নারী এখন, মার খাচ্ছেন নিয়মিত আর স্বামীজীকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে তাবিজ কবচ করছেন, আর সংসারের যাবতীয় খরচ নিজেই টেনে যাচ্ছেন!

ঘটনা চার
 
পরিচিত একজন কিশোরী, প্রায় অপরিচিত ভাইয়ার সাথে কথা বলতে বলতে প্রেমে যখন খুবই বুঁদ, তখন 'ভাইয়া ' জানালেন, তিনি শুধু টাইমপাস করেছেন।

ঘটনা পাঁচ
 
ফোনে পরিচয়। ছেলে একটা মধ্যমমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, মেয়ে একটা বাসার গৃহকর্ম সহায়তাকারী। ফোনে দুমাস কথাবার্তা বলে মেয়েটির দৃঢ় বিশ্বাস, এই ছেলেটি ভালোবাসার টানে সমাজ পরিবার ছেড়ে তাকে বিয়ে করে স্বীকৃতি দেবে। ছেলেটির সাথে ফোনে কথা বলে জানা গেলো, ফোনে নানা শ্রেণী পেশার মেয়েদের সাথে কথা বলা, প্রেম- এগুলো তার সময় কাটানোর উপায়।

আরও পড়ুন:


বরের গাড়িতে কনের সাবেক প্রেমিকের হামলার ঘটনায় আটক ২

ব্রিটেনে গাড়ি নির্মাণের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে

৬৩ পৌরসভায় নির্বাচন কাল

রাশিয়ার টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিলো ইরান


ঘটনা ছয় 

ঢাবির এক বিভাগ থেকে পাশ করে মেয়েটি কোন চাকরিবাকরি খোঁজেনি, করেনি। যেই বয়স্ক বিপত্নীক ভদ্রলোকের সাথে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, তিনিই মেয়েটির বাড়িভাড়া, বাজারখরচসহ সবরকম খরচ বহন করতেন। কিন্তু সামাজিক কোন স্বীকৃতি মেয়েটিকে দেননি, যদিও আশ্বাস দিয়েছেন এবং মেয়েটি অবলীলায় সে বিশ্বাস কয়েক বছর ধরে বহন করে এসেছে।

ভদ্রলোক সম্প্রতি মারা যাওয়ায় এখন মেয়েটির অথৈ সাগরে পড়ার দশা। তাকে বললাম, কোথাও টিউশন /চাকরির খোঁজ করতে ও কোন মহিলা হোস্টেলে উঠে যেতে। কিন্তু এতো অবোধ, পরনির্ভরশীলতার নাম ভালোবাসা কেমন করে হয়, তা আমি বুঝতে পারিনি।

মেয়েরা ভালোবাসলে, প্রেমে পড়লে যেন অন্ধ না হয়ে যায়, এটা কীভাবে যে বোঝানো যায়, তা-ই ভাবছি। আর ভাবছি মোবাইল ফোনের স্বল্প মূল্যের রাত বারোটার পরের প্যাকেজ,  আর ১০ টাকায় ১০০০ এসএমএসের অফারে কত ছেলে আর কত মেয়ে যে অজানা, অজ্ঞাতকুলশীল লোকজনের খপ্পড়ে পড়ে জীবন বরবাদ করছে, কে জানে!

একটা মানুষকে না চিনে, না জেনে, কি করে এতো ভাব-ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে, মানুষ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা  ভুলে যায়- তা আমার মাথায় আসেনা। চেনাজানা থাকলেও প্রতারিত হওয়া সম্ভব- সেটা আরেকটা ইস্যু।

কিন্তু মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে ছড়ানো অজানা অচেনা মানুষজনের সাথে প্রেমের মহামারীর ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে টিনএজারদের সচেতন করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলে আমি মনে করি।

আসুন, আমরা ছেলেমেয়েদের বন্ধু হই, (স্পাই নয়) তাদেরকে 'ভাবিয়া করিও কাজ' নীতির সাথে পরিচিত করি, আবেগজনিত দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানাই আর তাদেরকে ধ্বংসাত্বক প্রেমের ব্যাপারে তাদের সচেতন করি।

news24bd.tv আহমেদ