আমাদের একুশ এবং তার চেতনা

আমাদের একুশ এবং তার চেতনা

Other

আমাদের ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বিজ্ঞজনরা অনেক কিছু লেখালেখি করে থাকেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা থেকে শুরু করে অনেক নামিদামি লোক আমাদেরকে একুশের চেতনার বিষয়ে অনেক জ্ঞান দিয়ে থাকেন। তাদের জ্ঞান মতো যদি আমাদের মতো অতিসাধারণ লোকেরা চলাফেরা না করে থাকি, তাহলে ওনারা রাগ করে বসেন।

বেরসিকরা বলে থাকেন আজকাল এমন সব অবসরপ্রাপ্ত আমলা আমাদেরকে আমাদের অমর একুশের চেতনার বিষয়ে
জ্ঞান দিয়ে থাকেন, যারা কর্মজীবনে দিনে এক-দুবারের বেশি বাংলায় কথা বলতেন কিনা সন্দেহ আছে।

যদিও আমার তা বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হবে কী করে, যেখানে আমরা নামিদামি পত্রিকার একুশের বিশেষ সংখ্যায় আজকাল একশ্রেণির অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের লেখাপড়ে বায়ান্নের একুশে ফেব্রু য়ারির রক্তাক্ত চেতনার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারছি। বেরসিকরা এখানেও কথাবার্তা বলেন। বেরসিকরা বলেন এতদিন এই শ্রেণির আমলারা বাংলা ভাষার বারটা বাজিয়ে এখন বাংলা ভাষার দরদী সাজছেন।

মুখে মুখে আমরা সবাই বলে থাকি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। আসলে এটা আমাদের মুখের কথা। আমরা কখনো চাই না বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু হউক (আমরা বলতে এখানে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ এবং সুবিধাবাদী শিক্ষিত সমাজের একটা অংশকে বুঝানো হচ্ছে। ) আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো, সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্টির একটা বৃহৎ অংশ যদি নিজের ভাষায় কথা না বলে অন্যভাষায় কথা বলার সুযোগ পান, তখন আর আমাদের মহান একুশের চেতনা তাদের মধ্যে কাজ করেনা। অথচ এই শ্রেণির লোকেরা একুশের ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন সভা সমাবেশে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে ব্যবহার করার জন্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে জ্ঞান দিয়ে থাকেন। নিজেরা যখন ভাষার ব্যবহারের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেন, তখন তাদেরকে কেউ এ কথা জিজ্ঞেস করেনা, যেখানে আপনারা নিজেরাই বাংলা ভাষার ব্যবহার দিন দিন সংকোচিত করে ফেলছেন, সেখানে আবার আমাদের মতো লোকদেরকে কেন সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার জন্য তিরস্কার করে যাচ্ছেন। এদেশের সাধারণ মানুষের দল এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হউক, তা মন প্রাণ দিয়ে কামনা করে থাকে। সাধারণ মানুষ নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো ধরনের কার্পণ্য করে না। তারা এখনো নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির ব্যাপারে কোনো ধরনের আপোষ করতে চায় না।  

এদেশের সাধারণ মানুষ তার মুখের ভাষা এবং জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে নিজের সংস্কৃতি বির্সজন দিতে চায়নি বলেই, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। মানুষ যদি তার নিজের মুখের ভাষা এবং তার সংস্কৃতি ভুলে যেত, তাহলে আর আমাদের মুখের ভাষা রক্ষা করার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা শহীদরা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে মৃত্যু বরণ করত না। মানুষ আর যাই করুক না কেন, মুখের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার জন্য কখনো পিছপা হয় না। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠিরা বাঙ্গালীদের ওপর তাদের শাসন শোষণের স্টিমরোলার চালিয়ে যাবার জন্য প্রথম আঘাতটাই এনেছিল আমাদের ভাষার ওপর। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠিরা ধরে নিয়েছিল যদি বাঙ্গালীদের পদানত করে রাখতে হয়, তাহলে তাদেরকে অর্থাৎ বাঙ্গালীদেরকে নিজস্ব ভাষা থেকে উৎখাত করতে হবে।

বাঙ্গালীদেরকে যদি তাদের মুখের ভাষা থেকে উৎখাত করা যায়, তাহলেই সম্ভব হবে নিজেদের শোষন চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু বাঙ্গালীদেরকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী চিনতে ভুল করেছিল। তারা চিনতে ভুল করেছিল বলেই ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে পথ ধরে ১৯৭১ এর আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছি। গুটিকয়েক দালাল বিরুদ্ধবাদী ছাড়া এদেশের সর্বস্তরের মানুষ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকরেছিল। আগেই বলেছি মুখের ভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাপারে একটা ব্যক্তিত্ববান জাতি কখনো আপোষ করতে পারেনা। এটা শুধু ভাষার ব্যাপারে নয়, মানুষ যখন দেখে তার অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যাচ্ছে, তখন কিন্তু সে হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকে না। মানুষ তার ভাষা সংস্কৃতি, এমন কি তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেই।

আমাদের ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন শুধু মাত্র আজ বাঙ্গালীর অহংকার নয়। আজ নির্যাতিত সকল জাতির সংগ্রামের প্রেরণা হচ্ছে আমাদের ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আজ সারা পৃথিবীর মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা রূপে পালন করে থাকে।

মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা যোগিয়ে থাকে আমাদের ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য যখন কথা উঠে, তখন দেখা যায় আমরা সবাই দল মত নির্বিশেষে এক বাক্যে স্বীকার করে নেই, অবশ্যই আমাদেরকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। এখানে কেউ দ্বিমত করেন না। কিন্তু তারপরও দেখা যায় আমাদের অফিস আদালত থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতি  অবহেলা করতে। সেই অবহেলা করে থাকেন সেই সব ব্যক্তিরা, যারা মুখে মুখে বলে থাকেন সর্বক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। মূলত আমরা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছি, যেখানে আজ আমাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বিচারিতার মনোভাব খুব বেশি করে চর্চা করতে দেখা যায়। আমরা ভুলে যাই পৃথিবীর মধ্যে আমরা এমন এক জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। পৃথিবীর আর কোনো জাতি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণ দেয়নি। অথচ আমরা নিজেদের মর্যাদাকে নিজেরাই রাখতে পারছি না গুটিকয়েক শিক্ষিত আত্মস্বার্থবাদী মানুষের জন্য। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিই তাদের নিজেদের মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিয়ে থাকে নিজেদের উন্নতির স্বার্থে। এখানে নিজেদের উন্নতি বলতে দেশের সামগ্রীক অর্থনৈতিক উন্নতিকেই বুঝানো হয়েছে। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাব পৃথিবীর বড় বড় মনীষিরা সাহিত্য থেকে শুরু করে সব কিছুর চর্চাই নিজেদের মাতৃভাষায় করেছেন। পরে হয়তো বিভিন্ন ভাষায় তা অনুবাদ হয়েছে। আমাদের নৈতিকতা চর্চাকে একটা শুভ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মাতৃভাষার চর্চা সর্বক্ষেত্রে করে যেতে হবে। আমরা যদি নিজের মুখের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় নিজেদেরকে প্রকাশ করতে চাই, তাহলে তা হবে কাকের ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করার মতো।

আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ আমাদের মুখের বাংলা ভাষা অফিস আদালত থেকে শুরু করে সর্বস্তরে চালু করতে হলে যা করতে হবে, তাহল আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্টির প্রগতিশীল অংশকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। প্রগতিশীল অংশ বললাম এই জন্য যে, আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্টির মধ্যে একটি অংশের লোকজনেরা নিজেদেরকে নিজেদের স্বার্থের জন্য যে কোনো ধরনের রং ধারন করতে পারেন। তারা সভা সমিতিতে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেলে এমন ভাবে কথা বলেন, যা শুনলে মনে হবে দেশপ্রেমের ব্যাপারে তাদের ওপরে আর কেউ নেই। অথচ এই শ্রেণির লোকেরা সুযোগ পেলে লুটপাটের উৎসব চালাতে দ্বিধাবোধ করেন না। এই আত্মস্বার্থবাদী লোকেরা সুযোগ পেলে মাতৃভূমি ধর্ষণকারী লোকদের পেছনে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

আমরা যদি এই সব সুযোগ সন্ধানী লুটপাটকারী হীনস্বার্থ উদ্ধারকারী লোকদের মায়াবী কথার জালে জড়িয়ে গিয়ে দেশের বৃহৎ স্বার্থের কথা উপলদ্ধি করতে না পারি, তাহলে কিন্তু নিজেদের বিরুদ্ধে আমরা চলে যাব। কথাটা আমাদেরকে আজ বেশি করে মনে রাখতে হবে। কেননা আজ চারিদিকে মুখোশ পড়া লোকদের এত আনাগোনা বেড়েছে যে, যা দেখলে মনে হয় আমর যেন গভীর অন্ধকারে বসবাস করছি। অন্ধকার কোনো সময় মানুষের জন্য মঙ্গল আনয়ন করতে পারে না। মানুষের ও দেশের মঙ্গল আনয়ন করতে গেলে আমাদেরকে আলোর সন্ধান করতে হবে। আলোকিত জনপদে অন্ধকারের প্রাণীরা আসতে ভয় পায়। কেননা আলোর রেখা অন্ধকারের প্রাণীরা সহ্য করতে পারে না। অন্ধকারের প্রাণীরা সুবর্ণ আলোর তেজে জ্বলে পুড়ে যায়। সুবর্ণ আলোকরাশি আমাদের মনের সকল ভীরুতাকে কাটিয়ে আলোর পথে সংগ্রাম করার সাহস আমাদের মধ্যে জাগ্রত করে থাকে। আজ সময় এসেছে আমাদের মুখের ভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করার জন্য নতুন করে সংগ্রাম আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। সেই আন্দোলন হবে সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন।

সেই আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগোষ্টিকে অংশগ্রহণ করতে হবে। তার মধ্যে বিশেষ করে স্কুলকলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন আদালতের আইনজীবী বিচারক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কবি, সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক আমলা এবং লেখকসহ সর্বস্তরের সংস্কৃতিবান মানুষজনকে। ছাত্রছাত্রীদেরও নতুন করে ভাষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তবে সেই আন্দেলন জ্বালাও পোড়াও এর আন্দোলন হবে না। সেই আন্দোলন হবে মার্জিত এবং শান্তিপূর্ণ। বাসে ট্রাকে আগুন পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা যায়। কিন্তু একটি জনপদের জনগোষ্টির অধিকার আদায় করা যায় না। তা আমরা অতীতে দেখেছি। তাই বলছিলাম স্বার্থবাদীদের কথা না শুনে আমাদেরকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য অগ্রসর হতে হবে। তবেই আমাদের মন প্রাণ অন্তরের সকল স্তরের অন্ধকার দূর হবে। আমরা অন্ধকারের বিরুদ্ধের লড়াই করে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু করতে পারব। তার জন্য এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানী অবসরপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে হবে না।

লেখক- শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল, আইনজীবী, কবি, গল্পকার