“আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে”। না কথাগুলো তিনি শুধু বলার জন্য বলেননি, সত্যি সত্যি যখন উর্দি পরা বাহিনী ছাত্রদের উপর গুলি চালালো তিনি বুক পেতে দিলেন।
বলছি শহীদ শিক্ষক শামসুজ্জোহার কথা।
যতোবার আমি জোহা স্যারের কথা ভাবি আমার গা শিউরে ওঠে। চোখ ভিজে যায়। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, ১৯৩৪ সালে জন্ম শামসুজ্জোহার। ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালের প্রথমদিকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে শামসুজ্জোহা তার পরিবার নিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। এসময় ভাষা আন্দোলনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫৩ সালে তিনি রসায়নে বি.এসসি (সম্মান) এবং ১৯৫৪ সালে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি রসায়নবিদ ড. মোকাররম হোসেন খন্দকারের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য গবেষণা শুরু করেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬১ এই সময়ে পাকিস্তান অর্ডন্যান্স কারখানার সহযোগী কারখানা পরিচালক, সেখান থেকে যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসে রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানা। কিন্তু ১৯৬১ সালে রয়্যাল অর্ডিনেন্স থেকে ইস্তফা নিয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন। ওই বছরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। রাজশাহীতে অধ্যাপনাকালে তিনি বৃত্তি নিয়ে পুনরায় লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে চলে যান এবং ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে পুনরায় অধ্যাপনা শুরু করেন।
এরপর শুরু এক নতুন ইতিহাস। ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক এবং ১৯৬৬ সালে প্রাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের ১ মে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর করা হয়।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালের শেষ দিক থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন দানা বাঁধে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকায় ছাত্রনেতা আসাদকে হত্যা করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এসব ঘটনায় সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। বাদ থাকেনি রাজশাহীও।
ছাত্রনেতা আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ওই বিক্ষোভে পুলিশ হামলা চালালে বহু ছাত্র আহত হয়। সেদিন শিক্ষক সভায় শামসুজ্জোহা বলেছিলেন, আজ আমরা ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোন গুলি হলে তা ছাত্রের গায়ে না লেগে যেন আমার লাগে।
হয়েছিলোও তাই। ১৭ ফেব্রুয়ারির হামলার প্রতিবাদে পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। কিন্তু সেই বিক্ষোভ দমাতে স্থানীয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সামরিক বাঁধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রস্তুত সেনা-পুলিশও।
খবর পেয়ে ড. জোহা তখুনি ছুটে গেলেন সেখানে। তিনি যে শুধু শিক্ষকই নন, ছাত্ররা যে সব তাঁর সন্তানের মতো। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে সেখানকার সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ছাত্রদের উপর গুলি না চালানোর অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, গুলি করলে তার বুকের উপর দিয়ে করতে হবে। কাজেই যেন গুলি যেন না হয়।
বরিশালে সমাবেশের উদ্দেশে ইশরাকের বিশাল গাড়িবহর
সোনালী ও জনতা ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
যে কারণে থানায় অভিযোগ করলেন সৌরভের স্ত্রী ডোনা!
ড.জোহার সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেই সেনাবাহিনী ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই গুলি লাগে ড. জোহার বুকে যেমনটা তিনি বলেছিলেন, তার বুকের উপর দিয়ে গুলি করতে হবে। আর এভাবেই ছাত্রদের জীবন রক্ষায় শহীদ হন এক শিক্ষক। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাহিত করা হয়।
সেদিন যারা ঘটনাস্থলে ছিলো সেই পুলিশ, ছাত্র, রাজশাহীবাসী সবাই দেখলো অন্য এক দৃশ্য। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে ড. জোহা তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি তোমাদের বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার গায়ে লাগবে। সত্যি সত্যি ছাত্রদের ওপর গুলি শুরু হলে তিনি বুক দিয়ে প্রতিরোধ করেন।
ড. জোহার এই সাহসী মৃত্যু আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র দেশে বিক্ষোভের জোয়ার প্রবাহিত হয়। আইয়ুব সরকারের মসনদ কেঁপে উঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশের জন্য শামসুজ্জোহার সর্বোচ্চ ত্যাগের সম্মানে তাঁর নামানুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করে জোহা হল।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯-এর ভেতরে শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি তাঁর ছাত্রদের রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কথাটা আমি যতোবার ভাবি, যতোবার কল্পনা করি ছাত্রদের বাঁচাতে বুক পেতে দিচ্ছেন এক শিক্ষক আমার চোখ ভিজে যায়। এই যেমন লিখতে লিখতে এখন আমি কাঁদছি।
৫২ আগে আজকের এই ১৮ ফেব্রুয়ারি এই ঘটনা ঘটেছিল। গত কয়েকবছর ধরে এই দিনে জোহা স্যারকে নিয়ে লিখছি। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। আজকের যুগে ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই যেখানে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ভুলে সরকার-প্রশাসনের তেলবাজি করা, তারা একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহার নামটি স্মরণ করে নিজেদের বিবেক জাগ্রত করতে পারেন।
আমার মনে হয় শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শামসুজ্জোহা দিবস পালন করা উচিত। আমি এই দেশের নীতি নির্ধারক হলে আজকের দিনটা জোহা দিবস কিংবা শিক্ষক দিবস পালন করতাম। আজকের এই সকালে শহীদ শামসুজ্জোহাকে স্যালুট। স্যালুট এক শিক্ষককে। আপনারা মতো শিক্ষকরা আজীবন বেঁচে থাকবেন কোটি ছাত্রের স্যার হয়ে। স্যালুট স্যার।
শরিফুল হাসান, উন্নয়ন কর্মী
news24bd.tv আয়শা