যে কারণে আমি নিউইয়র্কে'র ‌‘দেশ’ পত্রিকা'য় লিখিনি

যে কারণে আমি নিউইয়র্কে'র ‌‘দেশ’ পত্রিকা'য় লিখিনি

Other

বিশ্বের রাজধানী-খ্যাত নিউইয়র্ক থেকে বেরুলো নতুন কাগজ। চকচকে নতুন একটি সাপ্তাহিক-- ‘দেশ’। এর উদ্যোক্তারা আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ, সুহৃদ। অধিকাংশজন ছিলেন প্রবাসের প্রধান কাগজ ‘ঠিকানা’য়।

আমিও একদা ‘বিশেষ সংবাদদাতা’ রূপে নিয়োগপত্র পেয়েছিলাম। দশক দশক সেই পর্যন্তই আছি অনিয়মিতরূপে।

নিউইয়র্কে ‘ঠিকানা’ বেরোয় প্রতি বুধবার। সাপ্তাহিক দেশ’-এর প্রকাশবারও ওই বুধবার।

উদ্যোক্তাদের বলেছিলাম-- এই ঠোকাঠুকি কেনো? উত্তর দিয়েছিলেন উদ্যোক্তা মনজুর হোসেন। তিনি সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি। ঠিকানার সর্বশেষ পরিচালক, বাণিজ্য ছিলেন।

বললেন, ডাকযোগে পাঠালে শুক্রবার অন্য রাজ্যে পৌঁছায়। শনি-রবি ছুটিবারে মানুষ মন-মজিয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া সোম-মঙ্গল কাজ সেরে রাতেই ছাপানো। বুধ-বৃহস্পতি-শুক্র-- বাজারজাতকরণ। বাণিজ্যিক বিকাশের জন্যে বুধবার প্রকাশনার বিকল্প নেই।

মনে মনে ঠিকানা'র ৩২ বছরের পুরনো উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ ৩২ বছর আগেই ওনারা 'বুধবারে'র উপযোগিতা বুঝেছিলেন। একটি স্মৃতি বারবার চলকে ওঠে। ১৯৮৯-এর অক্টোবরে সম্ভাব্য সম্পাদক এম এম শাহীন বাংলাদেশে এলেন। ঢাকায় ‘হোটেল প্রীতম’ থেকে আমাকে ফোন দিলেন। আমি তখন সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের নির্বাহী সম্পাদক। বললেন-- নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা এসেছি জরুরি কাজে। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করবো আমরা। নির্বাহী সম্পাদক কৌশিক আহমেদ একটি চিঠি দিয়েছেন। সেটি নিয়ে আপনার সঙ্গে মতবিনিময় করতে চাই।  

সেই যে এলেন, হৃদয়ের গহীনেই থেকে গেলেন। নিউইয়র্ক থেকে ঠিকানা বেরুলো ১৯৯০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। প্রায় দশ বছর পর মনজুরকে দেখি ঢাকাতেই। শাহীন সাহেবের ‘কাজিন ব্রাদার’ হিসেবে। নিউইয়র্কে  ঠিকানা’য় বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করে। ঢাকায় জমায়েত হয়েছে বিবাহ উপলক্ষে। বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর-সংলগ্ন ‘সন্তুর’ রেস্টুরেন্টে। শাহীন সাহেবের মহান মাতা-- প্রিয়-শ্রদ্ধেয় খালাম্মাও ছিলেন। সেই থেকে অনুজ মনজুর সর্বদা আমার সুপ্রিয়জন।

মনজুরে'র শেষ ফোনটি পেলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি'২১ সন্ধ্যায়। প্রকাশনা-প্রস্তুতিকালে অনেকবারই কথা হয়েছে। মনজুর জানালেন, কাজ প্রায় শেষ। 'সাপ্তাহিক দেশ' উদ্বোধনী সংখ্যা প্রেসে পাঠাচ্ছি। প্রায় ৩০০ পাতার আয়োজন, প্রবাসে রেকর্ড। ২০০৭-এ ঠিকানা করেছিলো ২৪০ পৃষ্ঠা। আমাদের 'দেশ'-এ প্রায় সব লেখাই নতুন। কোনরকম 'কাট এন্ড পেস্ট' না। প্রতিউত্তরে বললাম, অনেক অনেক শুভকামনা।  

না, এমন এক বিশাল বপুর আয়োজনে আমার লেখা নেই। আগেই বলেছিলাম-- থাকবে না। যুক্টিটি পূর্বে জানিয়ে দিয়েছিলামও। কারণ পত্রিকার নামটি মৌলিক নয়। সংবাদপত্র বা মিডিয়া একটি সৃষ্টিপ্রধান প্রতিষ্ঠান। এটি কেনো পুরনো বা নকল নাম ধারণ করবে? প্রথমত 'দেশ' শিল্প-সাহিত্যের অতীব পুরনো কাগজ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যে লালিত। সারা পৃথিবীতেই এর প্রচার প্রসার। আশির দশকে আমরা এর আঙিনায় ঠাঁই নেই। গল্প-কবিতা-সাহিত্য সমালোচনা-- সবটাতেই কলমচারণা।

পাঠের শুরু মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের শরণার্থীকাল শৈশবে। ১৯৮৫-তে 'দেশ' কার্যালয়ে আমাদের প্রবেশ শুরু। ইত্তেফাক'র 'রোববার'-খ্যাত ফটোসাংবাদিক বাতেন সিরাজসহ। 'কবির লড়াই' প্রচ্ছদের তিন কুশীলবকে একযোগে প্রাপ্তি। সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তখন থেকেই সুসম্পর্ক সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গেও। কী বিশাল ভাবমূর্তির মানুষটির গোপন আকুলতা ভুলিনি। বলতেন, যে মাটিতে জন্মেছি তাতে তোমাদের বসবাস। কলকাতা এলেই দ্বিধাহীনভাবে চলে আসবে। তোমাদের নৈকট্য মানে জন্মমাটির গন্ধ, স্মৃতিপেলবতা। 'দেশ' নামটির ভেতর হারানো বাংলাদেশ'কেই খুঁজে ফিরি।

সেই 'দেশ' নামটিই কি নিউইয়র্কে চুরি হয়ে গেলো! না, মহান মাতৃভাষার মাসে আমি তাতে লিখতে পারিনি। হাজার লেখক এমন নৈতিকতা'র রোগে ভোগেন না। আমি আমার নীতিমালা নিয়ে একটু নিভৃতেই থাকি। সরকারি দলের পক্ষে থাকলে সরকারি পদক জোটে। শীর্য পর্যায় থেকে হাতছানি দেয় প্রলোভন। আমি বলি আমরা অস্তিত্ববাদী জ্যা পল সার্ত্রের ভক্ত। ১৯৬৪-তে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান। বলেছিলেন-- ওটা আমার কাছে এক বস্তা আলুর সমান।  

উল্লেখ্য, একটি প্রামাণ্য ইতিহাস আজ তুলে ধরি। দেশ-সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ঢাকার একটি কাগজকেই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেটি আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে', ১৯৮৯-এ। নিয়েছিলো বর্তমানে 'এটিএন'-এ কর্মরত সুসাংবাদিক শহিদুল আজম। রাশভারী সাগরদা'র জন্ম বাংলাদেশের মেঘনা-সংলগ্ন চাঁদপুরে। পিতা কালীমোহন ঘোষের হাত ধরে চলে যান শান্তিনিকেতন। সেখানে, কলকাতায় লেখাপড়া, বিপ্লব, জেল খাটা। অতঃপর আনন্দবাজার গ্রুপে 'দেশ'-এ যোগদান। সম্পাদক ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সালে। পরকালে চলে গেলেন ১৯৯৯-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি। ওনার বিদেহী আত্মা যেন আমাদের সাহিত্যজীবন পাহারা দিচ্ছে।

আমি নবম শ্রেণিতে মফস্বল সাংবাদিকতা শুরু করি। থানা প্রতিনিধি ছিলাম সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী'র। আর সত্তর দশকের 'দৈনিক দেশ'-এর। দুটি কাগজ দুটি প্রধান রাজনৈতিক ধারায় বিভাজিত। একসঙ্গেই কাজ করেছি নিরপেক্ষতার পতাকা উড়িয়ে। আশির দশকে ঢাকার পূর্ণ-পেশাজীবনে মিডিয়াসরব ছিলাম। কিন্তু 'দেশ' নামাঙ্কিত কোনো মিডিয়ায় নয়।

প্রবাসের 'দেশ' পত্রিকাটির সাফল্য কামনা করি। যদিও নামের কারণে জন্মকালে আমাকে নাড়াতে পারেনি। কর্ম দিয়ে ভবিষ্যতে নাড়াবে আশা করি। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য ভাষায় তখন বলতে চাই--
তারে আমি কই জাদুকর,

যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভেতর!

নিউইয়র্ক,  ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
 # salemsuleri.ss@gmail.com

সম্পর্কিত খবর