প্রকৃতি যা শেখায় মানুষ তা পারে না

প্রকৃতি যা শেখায় মানুষ তা পারে না

Other

পৃথিবীতে কিছু কিছু বিষয় থাকে যেখান থেকে মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারে। মানুষ যদি একটি বিষয় হয়। তবে অনেকসময় মানুষের থেকেও অনেক বেশি সে বিষয়গুলো মানুষকে শেখাতে পারে। একটা উদ্ভিদ, হয়তো অনেকের কাছে মূল্যহীন।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বস যদি না বলতেন উদ্ভিদের জীবন আছে। কিংবা উদ্ভিদের যে জীবন আছে তা প্রমান করে না দেখাতেন, তবে হয়তো সবাই উদ্ভিদকে জড় পদার্থ বলেই উপহাস করত। উদ্ভিদের ভাগ্য ভালো, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসের মতো উদার চিন্তার মানুষ উদ্ভিদের ভিতরটাকে প্রাণ দিয়ে দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তাই আজ উদ্ভিদ জড়ের জড়তার প্রাচীর ভেঙে জীবের মর্যাদা ও অধিকার অর্জন করেছে।
উদ্ভিদকে কেউ ডাকে বৃক্ষ বলে, কেউ ডাকে গাছ বলে কিংবা অন্যকিছু। সবগুলোই সমার্থক ও একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি বৃক্ষ বা গাছের ভিত্তি হলো তার মূল বা শেকড়। শেকড় কেবল মাত্র গাছটিকে মাটির উপর শক্ত করে শুধু দাড় করিয়েই রাখে না, সঠিক খাদ্য দ্রব্য, খনিজ সরবরাহ করে তার পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ করে দেয়। উদ্ভিদ নিজের শেকড়কে চিনে ও শেকড়কে আপন সত্তার অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ বলে মেনে নেয় হয়তোবা আমরা মানুষ কি কখনো আমাদের শেকড়কে খুঁজি।

সে শেকড়কে খোঁজার মতো মন কি আমাদের আছে। হয়তো নেই। তাই হয়তো মানুষের মানবিক দেওয়ালগুলোতে অদৃশ্য ফাটল ধরেছে। মানবিক মূল্যবোধে পচনটা মানুষ থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হয়েছে। ব্যক্তিত্ব ধসে পড়েছে বাস্তবতার চিলেকোঠায়। ফলটা যা হবার তাই হয়েছে। মানুষ এখন মন্দের দাসত্ব স্বীকার করেছে। সব অন্ধকার জেঁকে বসেছে মানুষের ঘাড়ের ওপর। সে অন্ধকার মানুষকে তার হাতের অদৃশ্য সুতোর পুতুল বানিয়ে খেলছে নিজের মতো করে। মানুষ আছে তবে সে মানুষের মৌলিক সত্তার অস্তিত্ব নেই। সব যেন রঙ্গমঞ্চ, মানুষ যা না তা হয়ে রীতিমতো অভিনেতা হয়ে উঠছে। সুবিধাবাদী হয়ে উঠেছে। মুখটা এখন আর মানুষের নেই, মুখটা হয়ে গেছে মুখোশের। যা কিছু ভালো তাতেই তা মানুষের শেকড় থাকে। শেকড়ের শক্তি থাকে। সেটা এখন দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হবার মতো। উদ্ভিদ মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে। মানুষের মধ্যে সৃষ্টির নতুন চিন্তা তৈরি করে।  

একটা উদ্ভিদ মানুষের মধ্যে সৃষ্টির নতুন নতুন চিন্তা তৈরি করে দিলেও মানুষ মানুষের মধ্যে তা তৈরি করতে পারছে না। একটা উদ্ভিদ দিনে দিনে শিক্ষক হয়ে উঠেছে যা মানুষ পারেনি। রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা , চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল, মেটেরিয়াল সাইন্স, এনার্জি জেনারেশন সহ বিজ্ঞানের সব শাখাতেই উদ্ভিদ মানুষের মধ্যে নতুন জ্ঞান তৈরি করে গবেষণার ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে। সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকলা, মনস্তত্ব, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব  সহ জীবনের সকল মহতী চিন্তায় উদ্ভিদ মানুষের মনকে এমনভাবে আলোড়িত করে চলেছে যা বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব। উদ্ভিদ মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে চলেছে নিঃস্বার্থভাবে। আর উল্টোদিকে মানুষের মধ্যে কাজ করছে স্বার্থপরতা, লোভ, প্রতিহিংসা। একটা উদ্ভিদ মানুষের কাছে হতে পারে নগন্য কিন্তু মানুষকে পরোপকারের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে উদারভাবে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ ত্যাগ করে নিঃস্বার্থ হবার প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে অপার দৃষ্টিভঙ্গিতে। একটা নদী সমুদ্রে ভেসে গিয়ে মহাসমুদ্রের জন্ম দিচ্ছে। নদী প্রাণের টানে যেটা করতে পারছে মানুষ তো সেটা পারছে না। মানুষ মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই তো মানুষ হয়ে উঠেনা। মানুষের মধ্যে মনুষত্ব থাকলেই মানুষ হয়।  

মানুষের ভিতরে আগাছা জন্মেছে, পরগাছা জন্মেছে। মানুষ পরজীবী প্রাণীও হয়েছে। কিন্তু মানুষের ভিতরের মানুষটা কেন যেন মানুষ হয়ে উঠছে না। মানুষ কি প্রকৃতি নাকি প্রকৃতি মানুষ। সব যেন ওলোটপালোট। যুক্তি তর্কের বাইরে। তারপরও একটা সহজ সমীকরণ মানুষ আর প্রকৃতির কোরিলেশন তৈরি করে মানুষের ভিতরের অদেখা মানুষটাকে টেনে বের করে আনুক মাটির পৃথিবীতে। কারণ মাটিও যে প্রকৃতির অংশ হয়ে পদচিহ্ন রেখে দেয় মাটিতে। যে মাটিতে মানুষের  বিকাশ সে মাটিতেই মানুষের একটু একটু করে মিলিয়ে যাওয়া। হয়তো সময় সেখানে চোখ খোলা রেখেছে আরেক নতুন সময় দেখবে বলে। সময় হয়তো প্রকৃতি কিংবা প্রকৃতি সময়। যেখানে কোনো একটা অনিশ্চিত জায়গায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে একটা অদৃশ্য রেলগাড়ির অপেক্ষায়। মানুষের চোখের জল আর প্রকৃতির জল হয়তো সেখানটায় একটা যোগসূত্র গড়ে রেলগাড়ির সহযাত্রী হবে। কোনো একদিন। হঠাৎ বৃষ্টির জলের মতো করে। হয়তো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে একে অন্যকে। কিন্তু সেখানে দুটো সত্তা একক সত্তা হয়ে খুঁজে পাবেনা কাউকেই। হয়তো একটা জাদুর আয়না খুঁজবে সবাই। তখন হয়তো মানুষের ভিতরের প্রকৃতি ঢুকে যাবে অবলীলায়। প্রকৃতির বিচারটা খুব কঠিন। কিন্তু প্রকৃতি তো উদার। সে উদারতার বন্যায় মানুষের ভিতরের সব অন্ধকার ভেসে গিয়ে আলো হয়ে জন্ম নিবে আবার।

প্রকৃতির এমন অসংখ্য উপাদান আছে যেখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আজকের এই মানবিক সংকটের সময়ে সারা পৃথিবীতে প্রকৃতি শিক্ষক হয়ে উঠেছে। এমনটা মানুষ আগে কখনো ভাবেনি। কিন্তু এখন ভাবতে হচ্ছে। হয়তো এমন করে ভাবতে ভাবতেই একদিন সমাধান সূত্রটা প্রকৃতির মাথা থেকে নিঃসৃত হয়ে মানুষের মাথা থেকে বেরিয়ে আসবে বিজ্ঞানের মৌলিক আবিষ্কারের রং মেখে। হয়তো এটা স্বপ্ন আর স্বপ্নই তো একদিন সত্য হয়। যেমন সত্য হয় প্রকৃতির আদরে বড় হয়ে উঠা মূর্খ ও দরিদ্র মানুষটা। যার বড় বড় মানুষ শিক্ষক ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির মতো শক্তি শিক্ষক ছিল। যার অর্থ সম্পদ ছিল না কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের অহংকার ছিল।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
বিভাগীয় প্রধান, শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগ, ডুয়েট
সদস্য, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ

news24bd.tv / কামরুল