অপরিণত শিশুর পরিচর্যায় ক্যাঙ্গারু পদ্ধতি

অপরিণত শিশুর পরিচর্যায় ক্যাঙ্গারু পদ্ধতি

Other

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ তার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অথবা তার কাজগুলোকে আরো সহজ করে তুলতে প্রকৃতি বা পশুপাখির কাছ থেকে শিখেছে। এ শিক্ষা এখনো চলছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ ক্যাঙ্গারুর কাছ থেকে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়া শিশুকে কিভাবে পরিচর্যা করতে হবে তা শিখেছে। ক্যাঙ্গারু শাবক অপরিণত অবন্থায় জন্ম নেয়।

আর মা ক্যাঙ্গারু তার পেটের থলিতে তার এ অপরিণত শাবককে সযত্ন পরিচর্যা দিয়ে বড় করে তোলে। মানুষও নানা কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম দেয়।

সাধারণত বাল্যবিয়ে বা কিশোরী বয়সে বিয়ে, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় সময়ের আগে পানি ভাঙা, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। এ অপরিণত মানবশিশুকে ক্যাঙ্গারুর অনুকরণে পরিচর্যা করে সুস্থ বরে তোলার পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি।

কেএমসি চালুর গোড়ার কথা

আপরিণত শিশুর পরিচর্যায় ইনকিউবেটরের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের চিকিৎসায় কলম্বিয়ার চিকিৎসক ‘নাথালি চারপাক’ ১৯৭৮ সালে প্রথম ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি পদ্ধতি প্রচলন করেন । এটি গত ৩০-৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, ভারতসহ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, এ পদ্ধতি ব্যবহার করে গত ২০ বছরে ব্রাজিলে জন্মের পরপর নবজাতক মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি ইনকিউবেটরের চেয়েও অধিক কার্যকর। এতে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে কেএমসি

২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)’র উদ্যোগে মতলব হাসপাতালে প্রথম এই পদ্ধতি চালু করা হয়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলায় মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অপরিণত শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই, মায়ের তত্ত্বাবধানে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে বেশ সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে এটি মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সোয়া চার লাখ অপরিণত বয়সের নবজাতক জন্মগ্রহণ করে। অপরিণত ও অপেক্ষাকৃত কম ওজনের এসব নবজাতক শিশুর অকাল মৃত্যুরোধে সরকার নতুন জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে, যার আওতায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এতে সহায়তা করেছে । সারা দেশে এটি চালু হলে নবজাতক মত্যুর হার কমে আসবে।

news24bd.tv

যাদের জন্য প্রযোজ্য

নবজাতকদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো প্রি-ম্যাচিউর বা অপরিণত জন্ম। ৩৭ সপ্তাহের আগেই সিজারিয়ান অপারেশন বা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুই প্রি-টার্ম বা অপরিণত শিশু। এই সময় শিশুর শরীরে তাপমাত্রা কম থাকে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপরিণত থাকে। দুর্বলতার কারণে নবজাতক মায়ের বুকের দুধ টেনে পান করতে পারে না। খাবার পাকস্থলীতে না গিয়ে ফুসফুসে চলে যায় বলে শ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় সারা শরীরে সংক্রমণ হয়। জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপরিণত নবজাতকদের আরেকটি সমস্যা হলো, স্বল্প ওজন (আড়াই কেজির কম)। এদের বাঁচাতে শরীর গরম রাখা, ঠিকমতো পুষ্টি দেওয়া, যাতে ইনফেকশন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, যেনো শ্বাসকষ্ট না হয় তা দেখা, অক্সিজেন দেওয়া এবং প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়াসহ অনেক যত্ন নিতে হয়। এসব নবজাতককে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়।

ইনকিউবেটরেও ঝুঁকি থাকে

নবজাতক জন্মের পর শরীরকে সঠিক তাপমাত্রায় বা গরম রাখার জন্য প্রথাগতভাবে কাঁথা-কাপড় মুড়িয়ে মাথা ও হাত-পা ঢেকে রাখা হয়। উন্নত বিশ্বে ও বাংলাদেশের বড় বড় সেন্টারে ইনকিউবেটর বা রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে ৩৬ থেকে ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি খুবই ব্যয়বহুল এবং সব হাসপাতালে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নেই। আবার অনেক সময় ইনকিউবেটর নিজেই শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। কেননা এটি পরিষ্কার করা ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনেক জটিল। তাছাড়া ইনকিউবেটরে খরচের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সমস্যাও রয়েছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে তাপমাত্রার সমস্যা হয়ে শিশুর ক্ষতি হয়। এসব সমস্যা বিবেচনা করে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির সূচনা হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে অনেক ঝুঁকিমুক্ত।

কিভাবে দিতে হয়

ক্যাঙ্গারু পদ্ধতিতে প্রসূতি মা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া ও কম ওজনের শিশুকে বুকের চামড়ার সঙ্গে লাগিয়ে রেখে সুস্থ করে তুলতে পারে । মায়ের দুই স্তনের মধ্যে ত্বকের সঙ্গে শিশুটির ত্বকের সংস্পর্শ ঘটাতে হয়। অর্থাৎ ক্যাঙ্গারু যেভাবে পেটের থলেতে শাবককে আগলে রেখে শুশ্রূষা দেয়, মাকেও তেমনি তার বুকে আগলে রেখে শিশুর যত্ন নিতে হয়। অপরিণত নবজাতকের শরীরে তাপমাত্রা কম থাকায় মৃত্যুঝুঁকি থাকে। এ পদ্ধতিতে মা নবজাতককে বুকে জড়িয়ে রাখলে তার শরীরের তাপমাত্রা নবজাতকের শরীরে সঞ্চারিত হয়। তখন শিশুটি মায়ের দেহের তাপ থেকে উষ্ণতা পায়। এটি ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে কাজ করে মৃত্যুঝুঁকি কমায়।

এ পদ্ধতির সুবিধা

১। এ পদ্ধতির জন্য হাসপাতালে ভর্তি বা নার্সের প্রয়োজন হয় না বলে কোনো খরচ নেই।

২। শিশুকে স্তনের সাথে লাগিয়ে রাখলে মায়ের বুকে দুধ উৎপাদন রাড়াতে সহায়ক হয়।

৩। এতে মায়ের সঙ্গে নবজাতকের আত্মিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। আস্তে আস্তে নবজাতক নিজেকে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।

৪। শিশুর হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার শক্তি বাড়ে।

৫। শিশুর কোনো জটিলতা দেখা দিলে মা দ্রুত বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারে।

৬। মায়ের অবর্তমানে শিশুর বাবা, ভাই-বোন দাদি-নানি বা অন্যরাও এ পদ্ধতিতে শিশুর যত্ন নিতে পারেন।

কখন বন্ধ করা যাবে

হাসপাতালের পরিবর্তে বাড়ির পরিবেশে থাকলে নবজাতক ও মা এই পদ্ধতিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে এটি যেনো অবশ্যই মা ও শিশুর জন্য আরামদায়ক হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য বিশেষ বেড বা চেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুর ওজন ২৫০০ গ্রাম না হওয়া পর্যন্ত ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার চালু রাখতে হয়। শিশুটি পরিণত হলে হাত-পা বেশি নড়াচড়া করবে, অঙ্গগুলো টেনে বের করতে চাইবে, কাঁদতে থাকবে এবং মায়ের শরীরে লেগে থাকতে চাইবে না। তখন ক্যাঙ্গারু কেয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে শিশুর যত্ন নিতে হবে।

news24bd.tv / নকিব