নবীজি (সা.) এর বর্ণনায় ফেরেশতারা যেভাবে জান কবজ করেন
পরকালের যাত্রা

নবীজি (সা.) এর বর্ণনায় ফেরেশতারা যেভাবে জান কবজ করেন

অনলাইন ডেস্ক

কুরআনে পরকাল সংক্রান্ত ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। স্বর্গের আরব্য শব্দটি হল জান্নাত এবং নরকের আরব্য শব্দটি হলো জাহান্নাম । সমাধিতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রা সম্পূর্ণরূপে তাদের ঈমানের বা এক সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এবং সর্বোচ্চ সত্তা ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসের মাত্রার উপর নির্ভর করে। সঠিক, দৃঢ় এবং সুস্থ ঈমান অর্জনের জন্য একজনকে অবশ্যই ধর্ম নির্দেশিত কার্যাবলি পালন করতে হবে, অন্যথা তার ঈমান অবশেষে শ্বাসরুদ্ধ ও সংকুচিত হবে, এবং তিনি যথেষ্ট দীর্ঘ সময় ধরে ইসলাম পালন না করলে সেই ঈমান নির্জীব হয়ে যাবে।

তাই ইসলাম পালন করা পরকালে পুরস্কৃত হবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কেউ আল্লাহ্‌র নাম জপার জন্য তসবীহ্‌ গ্রহণ করতে পারেন।

মৃত্যু এক নির্মম সত্য। মৃত্যুর হাত থেকে কারোই রক্ষা নেই।

মানুষ-পশুপাখি-গাছপালা-তরুলতা সব কিছু এক দিন ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। পৃথিবীতে এক নির্ধারিত মেয়াদ পরিভ্রমণ করে যাত্রা করে অনন্তকালের পথে। এই যাত্রাপথ কারও জন্য হয় অনন্ত সুখের স্রোতধারা। কারও জন্য হয় নিকষ আঁধারে ঢাকা নরক-গহ্বর। দুনিয়ার পাপ-পুণ্যের ওপর নির্ভর করে কার যাত্রাপথ কেমন হবে। পাপে পাপে যারা কলুষিত করে ফেলে পার্থিব জীবন অনন্তপথের যাত্রায় তারা চরম দুর্ভাগা। মৃত্যু তাদের কাছে সাক্ষাৎযম। মৃত্যু থেকে বাঁচতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু মৃত্যুর ফেরেশতাগণ টেনেহিঁচড়ে তাদের প্রাণ বের করে আনেন।

পুণ্য ও সৎকাজে যারা জীবন আবাদ করে তাদের যাত্রা হয় আনন্দমুখর। তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হাসিমুখে। মৃত্যুর ফেরেশতাগণ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের প্রাণ হরণ করেন। তাদের আহলান সাহলান জানান। ঈমানদারের মৃত্যু হয় সহজ ও স্বস্তিদায়ক। কাফেরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত যন্ত্রণার। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা যাদের জান কবজ করেন তাদের পবিত্র অবস্থায়, ফেরেশতারা বলে, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। ’ (সুরা নাহল : ৩২)। পবিত্র অবস্থা বলে উদ্দেশ্য ঈমানের অবস্থা। সুতরাং ঈমান অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয় ফেরেশতাগণ তাদের শান্তি কামনা করেন।

ফেরেশতাগণ কীভাবে মানুষের প্রাণ হরণ করেন, নবীজি (সা.) একটি দীর্ঘ হাদিসে তা বর্ণনা করেছেন। হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা নবীজির সঙ্গে এক আনসারি সাহাবির জানাজায় গেলাম। আমরা কবরস্থানে পৌঁছলাম তখনও কবর প্রস্তুত হয়নি। নবীজি বসলেন। আমরা তার চারপাশে বসলাম। (আমরা এতটা শান্তস্থির ছিলাম) যেন আমাদের মাথার ওপর পাখি। নবীজির হাতে একটি কাঠি ছিল। সেটা দিয়ে তিনি মাটিতে দাগ কাটছিলেন। তারপর মাথা তুলে তিনি বললেন, তোমরা কবরের আজাব থেকে আল্লাহর পানাহ চাও। কথাটি দুবার বা তিনবার বললেন। তারপর বললেন, নিশ্চয় ঈমানদার বান্দার যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে পরকালের পথে যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে তখন উজ্জ্বল শুভ্র চেহারার ফেরেশতাগণ তার কাছে নেমে আসেন। উজ্জ্বলতায় তাদের চেহারাসমূহ যেন এক একটি সূর্য। তাদের সঙ্গে থাকে জান্নাতি কাফন ও জান্নাতি সুগন্ধি। তারা তার কাছে বসে পড়েন।

তারপর মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আ.) এসে তার মাথার পাশে বসে বলেন, হে পবিত্র আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এস। নবীজি (সা.) বলেন, তারপর পাত্রের মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া ফোঁটার মতো তার আত্মা বেরিয়ে আসে। আজরাইল সেই আত্মাকে বরণ করে নেন। আজরাইল হাতে নেওয়া মাত্র চোখের পলকে অন্য ফেরেশতাগণ সেই আত্মাকে সেই জান্নাতি কাফনে ও সেই জান্নাতি সুগন্ধিতে রেখে দেন। তার থেকে মেশকের উত্তম সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে, যা জমিনেও অনুভ‚ত হয়। নবীজি (সা.) বলেন, এরপর তারা সেই আত্মা নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করতে থাকেন। যখনই কোনো ফেরেশতা দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন ফেরেশতা দল জিজ্ঞেস করে, এটা কার পবিত্র আত্মা? তারা দুনিয়াতে থাকা তার ভালো নামসমূহ উল্লেখ করে বলেন, অমুকের ছেলে অমুক।


অভাব দুর হবে, বাড়বে ধন-সম্পদ যে আমলে

সংবাদ উপস্থাপনায় ও নাটকে রূপান্তরিত দুই নারী

করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণে বাধা নেই ইসলামে

কমেন্টের কারণ নিয়ে যা বললেন কবীর চৌধুরী তন্ময়


এভাবে তারা প্রথম আসমানে পৌঁছেন। আসমানের দরজা খুলতে আহ্বান করেন। তাদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হয়। এভাবে প্রত্যেক আসমানের নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে পরবর্তী আসমানে বিদায় জানান। এভাবে সে সপ্তম আসমানে পৌঁছে যায়। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দার আমলনামা ইল্লিয়্যিনে রেখে দাও এবং তাকে দুনিয়াতে ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় আমি তাদেরকে মাটি থেকে সৃজন করেছি এবং তাতেই ফিরিয়ে দেব এবং তার থেকে দ্বিতীয়বার বের করে আনব।

নবীজি (সা.) বলেন, তারপর তার রুহ তার দেহে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তারা তাকে বসান। জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? সে বলে, আমার রব আল্লাহ। তারা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? সে বলে আমার ধর্ম ইসলাম। তারা বলেন, তোমাদের নিকট পাঠানো এই লোকটি কে? সে বলে, তিনি আল্লাহর রাসুল। তারা বলেন, তোমার জ্ঞানের উৎস কী? সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি। তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং তা সত্যায়ন করেছি। তখন আসমানে এক ঘোষক ঘোষণা দেন আমার বান্দা সত্য বলেছে। তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। জান্নাতের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও। এরপর তার কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ ও সুরভি আসতে থাকে এবং তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত কবরকে প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একজন সুদর্শন সুন্দর পোশাক পরিহিত ও সুগন্ধিযুক্ত লোক আগমন করে বলে, আনন্দদায়ক সুসংবাদ গ্রহণ কর। এটা সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি তোমাকে দেওয়া হয়েছে। তারপর সে বলবে, কে তুমি হে কল্যাণকামী! সে বলবে, আমি তোমার নেক আমল। তারপর সে বলবে, হে আমার রব! কেয়ামত কায়েম কর, আমি যেন আমার পরিবার ও সম্পদের কাছে ফিরতে পারি।

নবীজি (সা.) বলেন, একজন কাফেরের যখন দুনিয়া থেকে বিদায়ের এবং পরকালের পথে যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আসমান থেকে কদাকার কিছু ফেরেশতা নেমে আসেন। তাদের সঙ্গে থাকে চট। তারা তার সামনে বসেন। তারপর মালাকুল মউত এসে তার মাথার কাছে বসেন। বলেন, হে অপবিত্র আত্মা! আল্লাহর রাগ ও অসন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এস। তারপর তিনি তার দেহে আঁচড়াতে শুরু করেন এবং দেহ থেকে আত্মাকে উৎপাটন করে নিয়ে আসেন।

আজরাইল তা হাতে নেওয়া মাত্র অন্য ফেরেশতাগণ সেই আত্মা চটে ভরে ফেলে। তার থেকে মৃত পচা লাশের দুর্গন্ধ বের হয়, যা দুনিয়ার মানুষও অনুভব করে। তারা একে নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করেন। তারা যখনই ফেরেশতাদের কোনো দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন ফেরেশতা দল জিজ্ঞেস করে, এই নাপাক আত্মা কার? তখন তারা দুনিয়াতে তার কুৎসিত নামসমূহ উল্লেখ করে বলে অমুকের ছেলে অমুক। এভাবে তারা প্রথম এরপর তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তারা তাকে বসান। তারা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? সে বলে, আমার রব আল্লাহ। তারা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? সে বলে আমার ধর্ম ইসলাম। তারা বলেন, তোমাদের নিকট পাঠানো এই লোকটি কে? সে বলে, তিনি আল্লাহর পৌঁছে। তার জন্য আসমানের দরজা খোলার আহ্বান করা হয়। কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না।

তারপর নবীজি এই আয়াত তেলাওয়াত করেন ‘তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যতক্ষণ না সুঁচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করবে। ’ আল্লাহ তখন বলবেন, তার আমলনামা জমিনের সর্বনিম্নে সিজ্জিনে রেখে দাও। তারপর তার রুহকে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

এরপর নবীজি কোরআনের আয়াত পাঠ করেন ‘এবং যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। ’ (সুরা হজ : ৩১)। এরপর তার রুহ দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তারা তাকে বসান। তারা তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তারা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তারা বলেন, তোমাদের নিকট পাঠানো এই লোকটি কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না! তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক বলবেন, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও।

 ফলে তার নিকট জাহান্নামের উত্তাপ ও লু হাওয়া আসতে থাকবে। তার কবর এতটা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয় যে, তার এক পাঁজরের হাড়গুলো অন্য পাঁজরে ঢুকে যায়। তার কাছে একজন কুৎসিত চেহারা, দূষিত পোশাক ও দুর্গন্ধযুক্ত এক লোক এসে বলে দুঃসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাকে এই দিনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সে বলে, তুমি কে? অকল্যাণ নিয়ে এসেছ? লোকটি বলবে, আমি তোমার বদআমল। তারপর সে বলবে, হে প্রভু! কেয়ামত যেন সংঘটিত না হয়। ’ (মুসনাদে আহমাদ : হাদিস ১৮৫৩৪)

অনেকের ধারণা, সব মানুষের রুহ কবজ করেন আজরাইল (আ.)। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। রুহ কবজ করার প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা হলেন মালাকুল মাউত। কিন্তু তাঁর সহযোগী বহু ফেরেশতা আছেন। তাঁরা মালাকুল মাউতের নির্দেশে এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও, তোমাদের জান কবজের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ফিরে যাবে। ’ (সুরা : সাজদাহ, আয়াত : ৩২)

ইবনুল কাইয়েম (রহ.) ‘ইলামুল মুওয়াক্কিঈন’ নামক কিতাবে (১/২১৪) এবং শাইখ আলবানি (রহ.) কিতাবুল জানাইজে (পৃষ্ঠা নং ১৫৯) এই হাদিসকে সহিহ বলেছেন। এই হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে মালাকুল মাউত তথা প্রাণ হরণের প্রধান দায়িত্বশীল ফেরেশতার সঙ্গে আরো সহযোগী ফেরেশতা রয়েছেন।

news24bd.tv/আলী